শুকিয়ে যাচ্ছে ইরাকের টাইগ্রিস নদী
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৩৩ PM , আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৪৭ PM
ইরাকের ঐতিহাসিক টাইগ্রিস নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে। ভয়াবহ দূষণ, উজানে বাঁধ নির্মাণ, জলবায়ু সংকট ও দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনায় নদীটি ক্রমেই শুকিয়ে যাওয়ার পথে। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে টাইগ্রিস নদীর তীরে বসবাসকারী প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলোর জীবন ও সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘পানি না থাকলে জীবনও নেই’ বলছেন মান্দায়ান ধর্মীয় নেতা শেখ নিধাম ক্রেইদি আল-সাবাহি। দক্ষিণ ইরাকের আমারা শহরে টাইগ্রিস নদীর তীরে বসবাসকারী এই ৬৮ বছর বয়সী ধর্মগুরু বলেন, তার ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী প্রবাহমান নদীর পানি ছাড়া অন্য কোনো পানি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এমনকি পান করতেও নদীর পানিই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু সেই নদীই এখন হয়তো আর প্রবাহমান থাকবে না।
মান্দায়ানরা বিশ্বের প্রাচীনতম গনস্টিক ধর্মগুলোর একটি অনুসারী। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ ইরাক, বিশেষ করে মাইসান প্রদেশ তাদের আবাসভূমি। টাইগ্রিস নদী তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু। বিয়ে থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব ধর্মীয় অনুশীলনে নদীর পানি অপরিহার্য।
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস—এই দুই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা। কৃষির সূচনা, লিপির আবিষ্কার, চাকার ব্যবহার—সবকিছুর পেছনেই ছিল এই নদীগুলো। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ ইরাকি টাইগ্রিস অববাহিকার পানির ওপর নির্ভরশীল।
তবে কয়েক দশক ধরে নদীটির স্বাস্থ্য ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরাকের আধুনিক পানি পরিশোধন অবকাঠামো ধ্বংস হয়। এরপর দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা ও সংঘাতের কারণে তা আর পুরোপুরি পুনর্গঠিত হয়নি। বর্তমানে দক্ষিণ ও মধ্য ইরাকে মাত্র ৩০ শতাংশ শহুরে পরিবার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে, গ্রামাঞ্চলে এই হার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
শিল্পবর্জ্য, তেল খাতের দূষণ, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং চিকিৎসা বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। ২০২২ সালের এক গবেষণায় বাগদাদের বিভিন্ন স্থানে টাইগ্রিসের পানির মান ‘খারাপ’ ও ‘অত্যন্ত খারাপ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০১৮ সালে দক্ষিণের বসরা শহরে দূষিত পানি পান করে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
নদীর পানিপ্রবাহও মারাত্মকভাবে কমে গেছে। গত ৩০ বছরে তুরস্ক টাইগ্রিসের উজানে একাধিক বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে, ফলে বাগদাদে পৌঁছানো পানির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ কমেছে। ইরানও সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু সংকট—ইরাকে বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ, চলছে প্রায় এক শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরা।
টাইগ্রিস রক্ষা আন্দোলনের সংগঠন ‘হুমাত দিজলা’-এর প্রতিষ্ঠাতা সালমান খাইরাল্লা বলেন, নদীর পানির পরিমাণ যত কমছে, দূষণের মাত্রা তত বাড়ছে। পানির গুণগত মান নির্ভর করে পরিমাণের ওপর।
এই সংকট মোকাবিলায় সম্প্রতি ইরাক ও তুরস্ক একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা ‘তেল-বদলে-পানি’ চুক্তি নামে পরিচিত। এতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক সেচব্যবস্থা ও পানি ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা চুক্তিটির বিস্তারিত না থাকা এবং এটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী মোহসেন আল-শাম্মারি বলেন, এটি প্রকৃত কোনো চুক্তি নয়, বরং নির্বাচনী প্রচারণার অংশ। উল্লেখ্য, চুক্তিটি ইরাকের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র নয় দিন আগে সই হয়।
টাইগ্রিস নদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগে রয়েছেন শেখ নিধাম। তিনি আশঙ্কা করছেন, নদী শুকিয়ে গেলে মান্দায়ান সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বা কুর্দিস্তান অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে ইরাকে মান্দায়ানদের সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম।
এক সময়ের প্রাণের উৎস টাইগ্রিস নদী আজ যদি হারিয়ে যায়, তবে তা শুধু একটি নদীর মৃত্যু নয়—একটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিলুপ্তির শঙ্কা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুত্র: দ্য গার্ডিয়ান