রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা © সংগৃহীত
রক্তের গ্রুপ মূলত দুই পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয়— এবিও এবং আর এইচ ফ্যাক্টর। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয় মানুষের পরিচিত আট ধরনের রক্তের গ্রুপ। তবে বিশ্বে মাত্র ৫০ জন মানুষের মধ্যে বিরল এক ধরণের রক্তের গ্রুপ যাতে আরএইচ ফ্যাক্টরের উপস্থিতি নেই (আরএইচ নাল) পাওয়া গেছে। প্রতি ৬০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র একজনের শরীরে থাকে বিরল এই রক্ত।
বিরল রক্তের গ্রুপ হওয়াই ল্যাবরেটরিতে এখন এই রক্তের গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করছেন গবেষকরা। পাশাপাশি যাদের এই বিরল রক্তের গ্রুপ রয়েছে তাদের নিজেদের রক্ত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। দুষ্প্রাপ্য হলেও এ রক্ত বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত মূল্যবান। চিকিৎসা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা মহলে একে কখনো কখনো 'গোল্ডেন ব্লাড' বলা হয় এর বহুমুখী ব্যবহারযোগ্যতার কারণে।
বিজ্ঞানীরা যেহেতু বর্তমানে দান করা রক্ত ব্যবহারে রোগ প্রতিরোধজনিত যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা দূর করার উপায় খুঁজছেন, সেহেতু এটি সবার শরীরে দেওয়া যায় এমন রক্ত তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। তবে যাদের রক্তে আরএইচ ফ্যাক্টর নেই যেসব মানুষদের রক্তে, তাদের মোট ৫০টি আরএইচ অ্যান্টিজেনের কোনোটিই নেই। যদিও এই ব্যক্তিরা অন্য কোনো ধরনের রক্ত নিতে পারেন না, তবে তাদের রক্ত সব ধরনের আরএইচ রক্তের ধরনের সঙ্গে উপযুক্ত।
এই বিষয়টি ও টাইপ আরএইচ নাল রক্তকে অত্যন্ত মূল্যবান করে তোলে। কারণ অধিকাংশ মানুষ এটি গ্রহণ করতে পারেন, যার মধ্যে এবিও-এর সব ভ্যারিয়েন্ট আছে এমন মানুষরাও অন্তর্ভুক্ত। জরুরি অবস্থায়, যেখানে রোগীর রক্তের ধরন নিয়ে তথ্য নেই, সেক্ষেত্রে কম এলার্জির ঝুঁকিতে থাকা ও টাইপ আরএইচ নাল রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এই কারণে, বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এই 'সোনালী রক্তের' মতো রক্ত তৈরির উপায় খুঁজছেন।
প্রফেসর টোয়ে বলেন, আরএইচ (অ্যান্টিজেন ট্রিগার) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কাজেই আপনার যদি (এগুলোর) কোনোটিই না থাকে, তাহলে আরএইচ-এর ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া করার মতো কিছুই থাকে না। তিনি আরও বলেন, যদি আপনি ও টাইপ এবং আরএইচ নাল হন, তাহলে এটি প্রায় সার্বজনীন। তবে এখনো অন্য রক্তের গ্রুপ আছে যা আপনাকে বিবেচনা করতে হবে।
আরএইচ-বিহীন রক্তের উৎপত্তি
সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, আরএইচ-বিহীন রক্ত জিনগত রূপান্তরের কারণে উৎপন্ন হয়, যা একটি প্রোটিনকে প্রভাবিত করে। এই প্রোটিনটি লাল রক্তকণিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এটিকে আরএইচ অ্যাসোসিয়েটেড গ্লাইকোপ্রোটিন বা আরএইচএজি বলা হয়। এই জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তনগুলো প্রোটিনটির আকার ছোট বা বিকৃত করে দেয়, যার ফলে অন্যান্য আরএইচ অ্যান্টিজেনের প্রকাশে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোয়ে ও তার সহকর্মীরা ল্যাবরেটরিতে আরএইচ নাল রক্তের অনুকরণ তৈরি করতে সফল হন। এর জন্য তারা ল্যাবে উৎপন্ন অবিকশিত কতগুলো লোহিত রক্ত কণিকা ব্যবহার করেন। এরপর গবেষকরা সিআরআইএসপিআর-সিএএস৯ নামের জিন এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাঁচটি প্রধান ব্লাডগ্রুপের অ্যান্টিজেন সংশ্লিষ্ট জিনগুলো মুছে ফেলেন।
এই পাঁচটি রক্তের গ্রুপে মিল না হওয়ার কারণে সাধারণত রক্ত সঞ্চালনে সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে এবিও এবং আরএইচ অ্যান্টিজেনের পাশাপাশি কেল, ডাফি এবং জিপিবি নামের অন্যান্য অ্যান্টিজেনও। প্রফেসর টোয়ে বলেন, আমরা বের করেছি যে এই পাঁচটি অ্যান্টিজেনকে যদি নিষ্ক্রিয় করা যায়, তাহলে একটি অতি সুসঙ্গত কোষ তৈরি করা সম্ভব, কারণ এর থেকে সবচেয়ে সমস্যা-জর্জরিত পাঁচটি রক্তের গ্রুপ সরানো থাকবে।
ফলে তৈরি হওয়া রক্তকণিকাগুলো সাধারণ প্রধান রক্তের গ্রুপগুলোর সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, তেমনই বিরল রক্তের ধরনের (যেমন আরএইচ নাল ও বোম্বে ফেনোটাইপ—যা প্রতি ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে একজনে পাওয়া যায়) সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
এরই মধ্যে প্রফেসর টোয়ে স্কারলেট কয়েকজনের সঙ্গে মিলে থেরাপিউটিক্স নামে একটি স্পিন-আউট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই কোম্পানি আরএইচ-বিহীনসহ বিভিন্ন বিরল রক্তের গ্রুপের মানুষের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করছে।
আরও পড়ুন: খুলনায় আদালতের সামনে গুলি করে কুপিয়ে ২ জনকে হত্যা
দলটি আশা করছে, এই রক্ত ব্যবহার করে তৈরি করতে এমন কোষগুচ্ছ, যা ল্যাবরেটরিতে অনির্দিষ্টকাল ধরে লাল রক্তকণিকা উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। এরপর এই ল্যাব-উৎপাদিত রক্ত হিমায়িত করে সংরক্ষণ করা যাবে, যাতে বিরল রক্তের গ্রুপের কারও জরুরি প্রয়োজন হলে তা ব্যবহার করা যায়। প্রফেসর টোয়ে আশা করছেন, জিন এডিটিং ব্যবহার ছাড়াই ল্যাবরেটরিতে বিরল রক্তের ব্যাংক তৈরি করা সম্ভব হবে, যদিও এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, যদি আমরা এডিটিং ছাড়া এটি করতে পারি, তবে দারুণ। কিন্তু এডিটিং আমাদের জন্য একটি বিকল্প। আমাদের কাজের একটি অংশ হলো সাবধানে দাতাদের নির্বাচন করা যাতে তাদের সমস্ত অ্যান্টিজেন বেশিরভাগ মানুষের জন্য যতটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করা যায়।
তাহলে সম্ভবত আমাদের জিন এডিট করতে হবে যাতে এটি সবার জন্য উপযুক্ত হয়। ২০২১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলওয়াকিতে অবস্থিত ভার্সিটি ব্লাড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইমিউনোলজিস্ট গ্রেগরি ডেনোম এবং তার সহকর্মীরা এক গবেষণা করেন।
সূত্র : বিবিসি বাংলা