ভাস্কর্যে ভাস্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রাজু ভাস্কর্য ও অপরাজেয় বাংলা
রাজু ভাস্কর্য ও অপরাজেয় বাংলা  © টিডিসি ফটো

১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই প্রতিষ্ঠানটি। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার এই বিশ্ববিদ্যালয়।

এসব আন্দোলন সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন কিংবা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে দেশ ও জনগণের কল্যাণে অবদান রেখেছেন তাঁদের স্মরণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভাস্কর্যের গল্প সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

অপরাজেয় বাংলা

May be an image of 1 person

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যের কথা বললে প্রথমে যে নামটি না বললেই নয় সেটি হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা। শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ রূপায়িত এটিই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত প্রথম ভাস্কর্য। তিন মুক্তিযোদ্ধার এ আবক্ষ ভাস্কর্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো, যে দিনগুলো ছিল বন্দীত্বের গ্লানি মুছে বাংলা মায়ের বক্ষবিদীর্ণকারী শত্রুদের মূলোৎপাটনের।

এই ভাস্কর্যের মাঝখানের ভাস্কর্যটি একজন বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি, যার বাম হাতে গ্রেনেড এবং ডান হাত রাইফেলের বেল্ট ধরা। ভাস্কর্যটির বাম দিকে রয়েছে হাতে রাইফেল ধরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এবং ডান দিকে রয়েছে সেবার প্রতীক মুক্তিযোদ্ধা নারী যার কাঁধে ঝুলছে প্রাথমিক চিকিৎসার একটি বক্স।

আরও পড়ুন: জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে প্রথম খুবির সাবেক ছাত্র বিজন হালদার

১৯৭৩ সালে ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’ নামে এটির প্রাথমিক কাজ শেষ হয়। পরে লোকমুখে পরিচিতি পায় ‘অপরাজেয় বাংলা’ হিসেবে। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এটি উদ্বোধন করা হয়। ভাস্কর্যটির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারীমূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ।

স্বোপার্জিত স্বাধীনতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভাস্কর্য - উইকিপিডিয়া

প্রধানত ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের লড়াইয়ের পরিণতি হলো মুক্তিযুদ্ধ। দেশের সব পেশার মানুষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ত্যাগের বিনিময়ে এই অর্জনকে স্মরণ রেখেই টিএসটির সড়ক দ্বীপে নির্মিত হয় ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’। এটি নির্মাণ করেন ভাস্কর শামীম শিকদার।

এই ভাস্কর্যের গা-জুড়ে রয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের কয়েকটি খণ্ডচিত্র। বেদির ওপর মূল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ওপরে বামে আছে মুক্তিযোদ্ধা কৃষক আর ডানে অস্ত্র হাতে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝখানে অস্ত্র হাতে নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা উড়িয়েছে বিজয় নিশান। এ ভাস্কর্য বেদির বাম পাশে আছে ছাত্র-জনতার ওপর অত্যাচারের নির্মম চেহারা। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এ ভাস্কর্য গড়া শেষ হয়।

রাজু ভাস্কর্য

চিত্র:Anti-Terrorism Raju Memorial Sculpture 3.A.M.R.jpg - উইকিপিডিয়া

বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের নিদর্শন এই ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এই ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মঈন হোসেন রাজু। ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর নকশায় ভাষ্কর্যের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ভাস্কর্য নির্মাণে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন গোপাল পাল। আর্থিক ও সার্বিক সহযোগীতায় কাজ করে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) এবং মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাষ্কর্যটি উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

স্বাধীনতা সংগ্রাম' একইসঙ্গে ভাস্কর্য ও ইতিহাস - আমরা ঢাকা

জগন্নাথ হলের পশ্চিম পাশে ফুলার রোডের একটি সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ এই ভাস্কর্য। এই সড়কদ্বীপে রাখা হয়েছে আরো অনেক ভাস্কর্য। এক জায়গায় এত ভাস্কর্য দেশের আর কোথাও নেই। মূল ভাস্কর্যটিতে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ তথা বিজয়ের আনন্দ ঠাঁই পেয়েছে।

আরও পড়ুন: স্কুল ছাত্রের ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট

ভাস্কর্যের সবচেয়ে উঁচুতে বন্দুকের সঙ্গে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা বাঁধা। তার নিচে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনীর উঁচু করা সেই চিরচেনা ভঙ্গি। ভাস্কর্যটিতে ৪২টি বাতি, একটি সংকেত বাতি, একটি লাইটিং, একটি পানির পাম্প ও ছয়টি পানির ফোয়ারা সংযুক্ত করা আছে। ভাস্কর্যগুলোর সবই নির্মাণ করেছেন ভাস্কর শামীম সিকদার। মূল ভাস্কর্যটি ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন মনীষীর ছোট ছোট অনেক ভাস্কর্য।

স্মৃতি চিরন্তন

ঢাবি জুড়ে স্বাধীনতা স্মারক | বাংলা

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে চরম ত্যাগ স্বীকারকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শহীদ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ‘স্মৃতি চিরন্তন’ স্মৃতিফলকটি ১৯৯৫ সালে‌ নির্মাণ করা হয়। স্থাপনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলোর সামনে (ভিসি চত্বর) অবস্থিত। কালো গ্রানাইটে নির্মিত এই স্থাপনায় ঢাবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৯৫ জন শহীদের নাম লেখা আছে।

পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে কংক্রিটের দেয়ালে বসানো পোড়ামাটির এসব ফলকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নামের তালিকা দিয়ে খোদাই করা ছিল জায়গাটি। তাই সেই সময়ে পরিচিতি পায় শহীদ বুদ্ধিজীবী চত্বর নামে। পরে ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুনর্নির্মাণ করে নাম পরিবর্তন করে ‘স্মৃতি চিরন্তন’ রাখে। এটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন স্থপতি মহিউদ্দিন সাকের।

মধুদার ভাস্কর্য

মধুসূদন দে - উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর নামে পরিচিত মধুর ক্যান্টিনের সামনে এই ভাস্কর্য অবস্থিত। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ মধুসূদন দের স্মরণে নির্মিত হয় এ ভাস্কর্যটি। ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। পরে ভাস্কর্যটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং ২০০১ সালের ১৭ মার্চ পুনর্নির্মিত ভাস্কর্য উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী। মধুদার ভাস্কর্যের নির্মাতা মো. তৌফিক হোসেন খান।

সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা

চোখে জল আনে 'সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা'

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরের স্মৃতির স্মরণে নির্মিত এই স্মৃতিফলকটি শামসুন্নাহার হলের পূর্বে এবং টিএসসির পশ্চিম পাশে টিএসসির সড়কদ্বীপে অবস্থিত।

আরও পড়ুন: ঢাবিতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সময় বেঁধে দিল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ

সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা ভাস্কর্যের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও নির্মাণ করেন ওই দুর্ঘটনায় আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের শিক্ষক শিল্পী ঢালী আল মামুন। স্মৃতিস্থাপনাটির নকশা প্রণয়ন করেন স্থপতি সালাহউদ্দিন আহমেদ। স্মৃতিফলকটি তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ব্র্যাক ও ব্র্যাক ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করা হয়।

রাউফুন বসুনিয়া ভাস্কর্য

রাউফুন বসুনীয়া - উইকিপিডিয়া

আশির দশকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া। বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

১৯৮৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে মিছিল চলাকালে স্বৈরাচার সমর্থকদের গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। রাউফুন বসুনিয়ার আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি  তাঁর একটি আবক্ষ প্রতিকৃতি ও তোরণ স্থাপন করা হয়, যা ‘বসুনিয়া তোরণ’ নামেই সমধিক পরিচিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলের গেটের পাশে অবস্থিত।

বীরশ্রেষ্ঠ স্মারক ভাস্কর্য

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিকে চির জাগ্রত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর সংলগ্ন আনোয়ার পাশা ভবনের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে এ ভাস্কর্য। এর স্থপতি শামীম শিকদার।

ঘৃণা স্তম্ভ

৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বাঙালি হয়েও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের হয়ে পাকিস্তানিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালি হত্যা করেছে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনে নির্মিত হয় ঘৃণা স্তম্ভ। ডাকসু ভবনের সামনে অবস্থিত ঘৃণা স্তম্ভ ২০১৭ সালে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে উদ্বোধন করেন ঢাবির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

এছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দ ভাস্কর্য, শান্তির পায়রা, বেগম রোকেয়া ভাস্কর্য, মা ও শিশু ভাস্কর্য, সপ্তশহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, নিঝুম স্থাপত্য, চারুকলার জয়নুল স্মৃতি ভাস্কর্য, শামসুন নাহার হলের পাশে অবস্থিত শহীদ মিজান ভাস্কর্য, বৌদ্ধ ভাস্কর্যসহ আরও কিছু ভাস্কর্য রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।


সর্বশেষ সংবাদ