ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে থামছেই না সাইকেল চুরি, দর্শকের ভূমিকায় প্রশাসন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড ও সিসি টিভি ক্যামরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড ও সিসি টিভি ক্যামরা  © টিডিসি ফটো

হাজার দুয়েক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে (সেন্ট্রাল লাইব্রেরি) নিয়মিত পড়াশোনা করেন। এখানে পড়তে আসা অনেক শিক্ষার্থী সঙ্গে সাইকেল নিয়ে আসেন। গ্রন্থাগারের সামনে একটি সাইকেল স্ট্যান্ড রয়েছে। সেই স্ট্যান্ডে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় গ্রন্থাগারের সামনেও তালা লাগিয়ে এসব সাইকেল রাখা হয়।

গ্রন্থাগারের ভবনে সিসি টিভি ক্যামরা থাকলেও প্রায় প্রতিনিয়ই এসব জায়গা থেকে সাইকেল চুরির ঘটনা ঘটছে। চুরি হওয়া এসব সাইকেল উদ্ধারের কোন উদ্যোগ তো দূরের কথা চুরি ঠেকাতে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সাইকেল চুরির ঘটনায় তারা একে অপরের উপর দোষারোপ করছেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।

তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। ফলে অনেকে টিউশনি, পার্টটাইম জবের জন্য নিয়মিত ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে হয়। এজন্য কিনতে হচ্ছে সাইকেল। কিন্তু যখন কষ্টের টাকায় কেনা সাইকেলটা ক্যাম্পাস থেকেই চুরি হয়ে যায় তখন দুঃখ-ক্ষোভটা তাদের অনেক বেড়ে যায়। 

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সাইকেল চুরির পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষও এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করছেন। তাদের কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব ও ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে চলছে চুরির মতো এসব ঘটনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরে প্রায় ১৫টিরও বেশি সাইকেল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে চুরি হয়েছে। যার কয়েকটি ছাড়া কোন কার্যকরি পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় ও লাইব্রেরি প্রশাসন নিতে পারেনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রন্থাগারের যেখানে সাইকেল স্ট্যান্ড রয়েছে সেখানে মাত্র একটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সাইকেল স্ট্যান্ডে অর্ধশতের মতো সাইকেল রাখা যায়। কিন্তু প্রতিদিন সাইকেল থাকে প্রায় ১০০ এর উপরে। যার কারণে সিসি ক্যামেরার বাইরে লাইব্রেরির বারান্দা, পিলারের সাথে সাইকেল রাখতে হয় শিক্ষার্থীদের। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায় চোর।

ভুক্তভোগী ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুরাদ হাসান বলেন, গত মাসের ৩১ তারিখে আমার সাইকেলটি চুরি হয়। প্রতিদিন আমার সাইকেল লাইব্রেরির সামনে রেখে পড়তে যাই। পড়াশোনা শেষে রাত সাড়ে নয়টার দিকে গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে দেখি আমার সাইকেলটি নেই। আমি গ্রন্থাগারের চারিদিক দুই-তিন বার ঘুরে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস হারিয়ে গেলে কতটা খারাপ লাগে সেটা এখন বুঝতেছি। আমি জানিনা আমার সাইকেলটি ফিরে পাবো কিনা তবে এই মূহুর্তে আমার পক্ষে নতুন আরেকটা সাইকেল কেনাও অসম্ভব। আর আমি চাইবো যে আমার মতো যেনো কেউ এমন ঘটনার শিকার না হন।

ম্যানেজমেন্ট এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস (এমআইএস) বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, গত মাসের ২৫ তারিখ দুপুরে আমার শখের সাইকেলটা চুরি হয়। এক ঘন্টার মধ্যে সাইকেলটা গায়েব হয়ে গেল। লাইব্রেরির বাইরে শুধু একটি সিসি ক্যামেরা আছে। সাইকেলটা আমার অনেখ শখের ছিলো! কষ্টটা এখনো কমেনি, কিন্তু পাওয়ার আশাটা আর নেই। প্রথম দুইদিন ছিলো! নিরাপত্তা বলতে বিন্দুমাত্র কিছু নেই ক্যাম্পাসে। এভাবে কি চলে? ক্যাম্পাস কবে নিরাপদ হবে?

তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে আমার সাইকেলটা চুরি হয়ে যায়। একটি সাইকেলের দাম খুব বেশি না হলেও ছাত্র জীবনে একজন ছাত্রের কাছে তার সাইকেলটি খুবই মূল্যবান। সেই সাইকেল চুরি হয়ে গেলে কতটা খারাপ লাগে, সেটা যে হারায় সেই ভালো জানে। ক্যাম্পাসে বহিরাগত/নেশাগ্রস্ত লোকজনের অবাধ বিচরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতাই প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি।

ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জাহিদ বলেন, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমার নতুন সাইকেলটা চুরি হয়। কিন্তু চোর ধরা পড়ে। চোরকে মারধর করাকে কেন্দ্র করে প্রক্টরিয়াল টিম ও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ওই সময় প্রক্টর স্যার এসে সবার সামনে কথা দেন সাইকেলের ব্যবস্থা তিনি করবেন, আমরা যেন চোরকে পুলিশের কাছে দিয়ে দেই। তার আশ্বাসে আমরা চোরকে পুলিশে দিলাম। কিন্তু এখনও আমার সেই সাইকেল পেলাম না।

ফারসি ভাষা সাহিত্য বিভাগের মো. গাজী ইমরান বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার সাইকেলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি এর সামনে থেকে চুরি হয়ে যায়। আমি আমার টিউশনের টাকা দিয়ে অনেক কষ্ট করে এটা কিনেছিলাম। আমার গুলশানে টিউশন করতে যেতে হতো, সাইকেল চুরি হওয়ায় আমি আর টিউশনে যেতে পারিনি।

আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদ খান বলেন, ১০ নভেম্বর ২০১৮ সন্ধ্যায় আমার সাইকেলটা চুরি হয়। বরাবরের মতো সকালে আমি সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে পড়তে এসে সাইকেল স্ট্যান্ডে রাখি। কিন্তু রাত ৮টার দিকে নেমে সাইকেলটা পাইনি। সাইকেল স্ট্যান্ড বরাবর একটা সিসিটিভি থাকলেও সেটা কাজ করছিলো না। বহু বছর ধরে বহু সাইকেল চুরি হলেও চুরি ঠেকাতে লাইব্রেরি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। যারা টিউশনি করে ,তারা জানে সাইকেল চুরি হলে কত বড় সমস্যায় পড়তে হয়।

হোসেন আল নাঈম বলেন, আমার দুইটা সাইকেল চুরি হয়েছে। একটা গতমাসে আর একটা ২০১৮ সালে আরেকটা। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে যখন দেখি সাইকেল নেই, এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। নিজের সবটুকু সম্বল হারিয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়তো একেই বলে। এর জন্য একটি অনিরাপদ সাইকেল পার্কিং ও ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ দায়ী বলে মনে করি।

এদিকে সাইকেল চুরির বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ’ নামক ফেসবুক গ্রুপে অনেকেই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

আব্দুল্লাহ নাকিব নামের একজন লিখেছেন, এতো পরিমাণ চুরি হবার পরেও তাদের টনক নড়ে না, চুরি নিজেরা করে নাকি সাহায্য করে সন্দেহের বিষয়।

নজরুল ইসলাম লিখেন, এইটা নিয়ে কারো কোন কনসার্ন নেই। লাইব্রেরি, ডাকসু, কলাভবন, আইবিএ, মধুর ক্যান্টিন, সমাজবিজ্ঞান ভবন এই প্লেসগুলোতে অনেকেই সাইকেল নিয়ে আসে। এই কয়েকটা স্থানের জন্য নিরাপদ সাইকেল পার্কিং এর জন্য একটা স্থান বানানোর কথা আমাদের অভিভাবকরা চিন্তাও করে না। কোন দাবি করতে গেলে বলে নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে কত সব নিয়ম আছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই। একটা সাইকেল শিক্ষার্থীদের অনেক কাজে দেয়। অনেকে চোরের ভয়ে সাইকেল কেনে না।

তানজির আহমেদ লিখেন, এর পেছনে একমাত্র দায়ী ক্যাম্পাসে অবাধ বহিরাগতের আগমন। এত এত চুরির ঘটনা ঘটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি আজ পর্যন্ত। মো. লোকমান সরকার লিখেন, ছাত্রবান্ধব প্রশাসন ছাড়া ক্যাম্পাস নিরাপদ সম্ভব না।

তবে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি কতৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর জন্য দায়ী। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দিন মুন্সী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী। সেখানে একটা সিসি ক্যামেরা আছে যা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না। এছাড়া যে সাইকেল স্ট্যান্ড রয়েছে সেটাও পর্যাপ্ত নয়। আমরা প্রশাসনকে সিসি ক্যামেরার বিষয়ে অনেকবার বলেছি কিন্তু তাদের কোন পদক্ষেপ নেই। একটা ক্যামেরা নষ্ট হলে ৬ মাস লাগে সেটা প্রতিস্থাপন করতে। এখানে আমাদের কোন করার নাই।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন ভিন্ন কথা। চুরি রোধে তাদের পদক্ষেপ যথেষ্ট রয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, এটা লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। লাইব্রেরির উন্নয়ন বিভাগে যিনি দায়িত্বে রয়েছেন তার সাথে কথা বলেন। তবে এর আগে কয়েকটা সাইকেল আমরা উদ্ধার করেছি।


সর্বশেষ সংবাদ