আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও খুঁজছে জাবির নিখোঁজ সেই ছাত্র রাজুকে
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২১, ০২:৩০ PM , আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২১, ০২:৩০ PM
একমাস ধরে নিখোঁজ থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) রসায়ন বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান রাজুকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরাও। জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্নাতক শেষ হলেও বাকি রয়েছে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা।
পারিবারিক সূত্র বলছে, করোনা মহামারিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় রাজধানীর মিরপুরের একটি মেসে ওঠেন জাহিদ। নিচ্ছিলেন সরকারি চাকরির প্রস্তুতিও। গত ২৪ জুন টিউশনি করতে বের হয়ে মিরপুর-৬ থেকে নিখোঁজ হন তিনি। এরপর পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর পল্লবী থানায় সাধারণ ডয়েরি করা হয়। গত এক মাস ধরে তার পরিবার বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলেও কোনো কাজ হয়নি। খোঁজ মেলেনি জাহিদের।
তবে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে অনলাইন সেল খোলেন জাহিদ। এই সেলগুলোকে বলা ‘ইদাদ’। এমন তিনটি ইদাদ রয়েছে। প্রতিটি ইদাদে ২০ জন করে সদস্য জাহিদ হাসানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে অনলাইনের মাধ্যমে। এই তিন অনলাইন সেলে ৫০-৬০ জন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যাদের বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তারা গ্রেফতারের এড়াতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করার জন্যই এই সেল খোলা হয়।
জাহিদ হাসানকে গ্রেফতারের বিষয়ে সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, জাহিদ বড় মাপের জঙ্গি। শিক্ষাজীবন থেকেই সে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তাকে আমরা গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
তথ্যমতে, ২০১৬ সালে রাজধানীর হলি আর্টিসান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো। তবে এর ঠিক তিন বছর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পুলিশ বক্সে ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস ব্যবহার করে হামলা ও হামলাচেষ্টার মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসে জঙ্গিরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব হামলার সঙ্গে জড়িত নব্য জেএমবির সদস্যরা। হামলার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে সিটিটিসি। কিন্তু তারপরও তাদের বোমা তৈরি বন্ধ করা যায়নি। সর্বশেষ গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর থেকে শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়।
এ ঘটনায় গত ১১ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে নব্য জেএমবির সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলারকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এছাড়া একইদিনে কেরানীগঞ্জ থেকে নব্য জেএমবির আরেক সদস্য কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামাকে গ্রেফতার করা হয়।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতার এই দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে নব্য জেএমবির বোমা তৈরির এক কারিগর জাহিদ হাসান ওরফে রাজু ওরফে ফোরকান ভাই ওরফে কাতারপ্রবাসী ফোরকানের নাম পাওয়া যায়। হলি আর্টিসান হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার এক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এর আগে জাহিদের বিষয়ে প্রথম তথ্য পায় সিটিটিসি।
তারপর থেকেই তাকে শনাক্তের চেষ্টা চলছিল। সর্বশেষ ওসামা ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পায় সিটিটিসি।
জানা যায়, জাহিদ হাসান ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক পাস করেন। ওই বছরেই অনলাইন দাওয়াতের মাধ্যমে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন তিনি। অবশ্য ২০১৪ সালে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জাহিদ হাসানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পেয়েছে সিটিটিসি। বর্তমানে জাহিদ হাসান পলাতক রয়েছেন।
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি শরিফুল ইসলামকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেফতার করে র্যাব। শরিফুল ইসলাম হলি আর্টিসান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসি প্রথম জানতে পারে যে, কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক ছাত্র নব্য জেএমবির বোমা তৈরির শাখার প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। আর তিনিই মূলত নব্য জেএমবির সদস্যদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। তবে শরিফুলের কাছ থেকে জাহিদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা।
যেভাবে শনাক্ত হলেন জঙ্গি জাহিদ
সিটিটিসির একটি সূত্রে জানা যায়, পুলিশ বক্সে বোমা হামলাগুলোর ঘটনার তদন্তে একটি বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হামলায় ব্যবহার করা বোমাগুলো একই ধরনের এবং সেগুলো দেশীয়ভাবে তৈরি। তখন তদন্তকারীরা বুঝতে পারেন, বোমাগুলো নির্দিষ্ট একজনের ফর্মুলায় তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে এসব হামলার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও বোমা তৈরি থেমে ছিল না। কোথা থেকে এই বোমা আসছে আর নতুন নতুন পুলিশ বক্সে হামলা হচ্ছে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
পুলিশ বক্সে হামলাগুলোর তদন্তে সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এই বোমার কারিগর নব্য জেএমবির কোনো নতুন সদস্য নয়, বরং তিনি একজন পুরোনো সদস্য। পরে সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি ওসামা এবং আব্দুলা আল মামুনের দেওয়া তথ্য ও গত কয়েক বছরের তদন্তের মাধ্যমে নব্য জেএমবির বোমার কারিগর জাহিদ হাসানকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
জঙ্গি জাহিদের বিষয়ে ডিএমপির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, দেশে যখন ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ তৈরির প্রমাণ পাওয়া যায় তখন থেকেই ধারণা করছিলাম এর সঙ্গে রসায়ন পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী জড়িত। তখন থেকেই আমরা জাহিদকে খুঁজছি। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গ্রেফতার দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও জাহিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। আমরা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
অনলাইনে বোমা বানানো শেখান জাহিদ
সিটিটিসি সূত্রে জানা যায়, এক সঙ্গে চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট বাসায় বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর এই আশঙ্কা থেকে অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন জাহিদ। জাহিদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নব্য জেএমবির কোনো সদস্য বোমা বানানোর পর যদি কাজ না করতো তাহলে তারা তাকে সরাসরি ভিডিও কল দিতেন। পরে জাহিদ তাদের ভিডিও কলের মাধ্যমে সব কিছু আবারও বুঝিয়ে দিতেন।
সর্বশেষ সাইনবোর্ড ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার নব্য জেএমবির সদস্য মামুন সিটিটিসিকে জানান, তিনি তিন দিন বোমা বানানোর পরেও কাজ করেনি। নব্য জেএমবির আরেক জঙ্গি মাহাদি হাসান জন তাকে একটি অনলাইন আইডি দেয়। সেই আইডিতে জাহিদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে তার পরামর্শ অনুযায়ী বোমা বানান মামুন। পরে সেই বোমা কাজ করে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা করে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। এসব ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গিরা জানান, তারা সবাই বোমা বানাতে পারেন। এত জঙ্গি কিভাবে বোমা বানাতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানতে পারেন, নব্য জেএমবির বোমা বানানোর সেল রয়েছে। এই সেলের প্রধান জাহিদ হাসান।