৫ মাস আগে উদ্যানের গেট বন্ধ করতে চেয়েছিল ঢাবি প্রশাসন, বিরোধিতায় হয়নি বাস্তবায়ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা  © সংগৃহীত

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি উদ্যান। এর বড় একটা অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) লাগোয়া। তবে এই উদ্যানে বহিরাগতদের দিন-রাত বিচরণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি কর্তৃপক্ষ, এমন অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর একাধিকবার চিঠি দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট গেটগুলো বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

গত ২ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দুটি বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নির্বাহী প্রকৌশল দপ্তরে নগর পিডব্লিউডি বরাবর চিঠি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দুটি বন্ধ করা প্রয়োজন গেটের শিকগুলো যেহেতু দুর্বৃত্তরা ভেঙে ফেলে, সেহেতু গেটের শিকগুলোকে মোটা স্টিল প্লেন শিট দিয়ে ঝালাই করে গেট বন্ধ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।’

ঢাবি ক্যাম্পাসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের যাতায়াত রয়েছে। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সব শ্রেণির নাগরিক অংশ নেয়। ছুটির দিনসহ বিশেষ দিনগুলোয় ক্যাম্পাস এলাকায় থাকে অপ্রত্যাশিত ভিড়। এই ভিড়ের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে চুরি, ছিনতাই ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরেই ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের কথা বলে আসছিল।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ ক্যাম্পাসে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ঘোষণা দেন। ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। বিষয়টাকে ‘ক্যান্টনমেন্টের আচরণ’ ও ‘অপ্রয়োজনীয় মাতব্বরি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন শিক্ষকরা, ‘অযৌক্তিক’ বলছেন ছাত্রনেতারা ও বিষয়টি ‘অসম্ভব ও অনুচিত’ বলছেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

তখন বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগকে ‘অপ্রয়োজনীয় মাতব্বরি’ আখ্যা দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘অপ্রয়োজনীয় মাতব্বরি বন্ধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিন। পড়াশোনা নামক একটা কাজের জন্য আপনারা প্রশাসকের চেয়ারে বসেন, সে কথা ভুলে গিয়ে চৌকিদারিতে সময় দিয়েন না!’

বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ উচিত নয় বলে দাবি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে নিজের আইডিতে এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢালাওভাবে “বহিরাগত” নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, উচিতও নয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অ্যাকাডেমিক পরিবেশ বিঘ্ন না ঘটে। একসঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিসর যাতে উন্মুক্ত থাকে এবং জনগণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিথস্ক্রিয়ারও সুযোগ থাকে৷ “বহিরাগত” জনগণের থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ অতি জরুরি।’

আরও পড়ুন : ‘উদ্যানে দোকান বসানো চাঁদাবাজ ছাত্রনেতারাই হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী’

অভিযোগ উঠেছে, কোনো এক অজানা কারণে বা মাদক ব্যবসায়ীদের অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে গণপূর্ত সেই অনুরোধ রাখেনি। এসব গেট ঢাবি প্রশাসন বন্ধ করলেও গণপূর্ত তা আবার খুলে দেয়! পাশাপাশি এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরনার কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও জড়িত বলে জানা গেছে।

সে সময় ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজির স্বার্থে যে বিপুল পরিমাণ দোকান স্থাপন করা হয়েছিল এবং সেসব দোকানকে কেন্দ্র করে বিপুল মানুষের সমাগম হতো, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করেছে। তাই টিএসসি থেকে এই দোকানগুলো উচ্ছেদ করা জরুরি শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করার জন্য। যাতে খাবার দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি না হয়।’

২০২৪ ২৬ সেপ্টেম্বর অনলাইন পোর্টাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসে ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দোকানে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি, ভাগ পেতেন সৈকত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবৈধ দোকান আছে ১৬৪টি। এ সংখ্যা প্রতিদিন চাঁদার ওপর নির্ভর করে কমবেশি হয়। এর মধ্যে সিগারেট ও চায়ের দোকান ২৪টি, শিঙাড়া ও চপের ১৪, ফুচকা ৩০, কাবাব ৭, আইসক্রিম ১৫, সাজসজ্জাসহ বিভিন্ন প্রসাধনী ২৯, শরবত ১৫, পিঠা ৫, চিকেন মমো ১৯, কাপড় ২, আচার ৭ ও দইয়ের দোকান রয়েছে তিনটি।’

একাধিক সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘এসব দোকান থেকে গড়ে ২৫০ টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় ৪১ হাজার টাকা। সে হিসাবে মাসে ১২ লাখ টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এ ছাড়া দোকান স্থাপনের জন্য দোকানিদের অগ্রিম দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। সে হিসেবে এককালীন ৮ লাখ টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে।’

কয়েকজন দোকানি ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছিলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক নিজামুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অধিকাংশ দোকান তার নিয়ন্ত্রণে। দোকান দেখাশোনা ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বাবা শাহজাহানের বিরুদ্ধে। একই কমিটির সহসভাপতি খোকা উদ্যানের লাইনম্যান হিসেবে দায়িত্বরত। তার বিরুদ্ধে মাদক কারবারেরও অভিযোগ রয়েছে। আরেক নেতা অলি শিশু পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। গাঁজা বিক্রির অভিযোগে তিনি কয়েকবার জেলেও গেছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নিজামুদ্দিনের মামাতো ভাই নান্নু। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে দোকানিদের এনে উদ্যানে বসিয়ে ৫ হাজার টাকা করে আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার ভাই রমিজও চাঁদাবাজিতে যুক্ত বলে জানা গেছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতেন। চাঁদার অংশ তাকেও দিতে হতো।’

ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমাদের ভাই সাম্য হত্যার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায় গণপূর্ত উপদেষ্টা আদীলুর রহমানের। আমরা বলতে চাই, উদ্যান পরিচালনার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে ঢাবির সঙ্গে লাগোয়া উদ্যানের সব গেট স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বুধবার (১৪ মে) দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি গণপূর্তকে চিঠি দিয়েছি, মৌখিকভাবে বলেছি, তাদের আমার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিটিং করে বলেছি, এরপরও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আজও আমরা ২টার সময় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা, গণপূর্তের সচিব, ডিএমপি কমিশনার, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিইও, তাদের সঙ্গে বসব। এ বিষয়ে কবে কখন কত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটা তাদের কাছে জানতে চাইব। তাদের আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তারাও আগ্রহ দেখিয়েছেন কথা বলার জন্য।

ঢাবি নিরাপত্তার স্বার্থে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন কি না, এ বিষয়ে প্রক্টর বলেন, আমরা ক্যাম্পাসকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রথম থেকে যে প্রটেকশন নিচ্ছি, সেগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে প্রতিপালন করতে চাই। অনেক রকম বাধাবিপত্তির মধ্যেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার ধারণা এ ব্যাপারে সব মহল আমাদের সহায়তা করবে। প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুধী সমাজ, আমাদের অ্যালামনাই, আশা করি সবাই সহযোগিতা করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধান করা জরুরি।

উদ্যানের ভেতরে অবৈধ ও ভাসমান দোকান উচ্ছেদ নিয়ে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব দোকান উচ্ছেদে আমরা বহুবার অভিযান চালিয়েছি। যৌথ বাহিনীর অভিযান চালিয়েছি। আর্মি, এপিবিএন, বিজিবি, সিটি করপোরেশন, আমার টিমসহ তিনবার অভিযান চালিয়েছি। আবার এরা কোনো না কোনোবাবে চলে আসছে। এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা দরকার। এখানে দোকান দেন, তাদেরও সজায়তা লাগবে। আশা করি এ বিষয়ে আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। এবার এটা হতেই হবে।


সর্বশেষ সংবাদ