এক বছরে সাত বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে স্থান, ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্পষ্ট রাবির অগ্রগতি
- মারুফ হোসেন মিশন, রাবি
- প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৪:২১ PM , আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ০৪:৫১ PM
যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উঠে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন ইমপ্যাক্ট র্যাংকিং, টাইমস হায়ার এডুকেশনের বিষয়ভিত্তিক র্যাংকিং এবং ইউএস নিউজ বেস্ট গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো স্থান অর্জন করে এ বিদ্যাপীঠ।
কীভাবে এমন লাগাতার সফলতা অর্জন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি? সামনে আরও এগোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনাই–বা কী? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষ্যে আজ থাকল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের বিশেষ আয়োজন।
আজ ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত বছর থেকেই আসছে একের পর এক সুখবর; সেরা ৭টি আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে। বাজেট-স্বল্পতাসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়েও যে এমন অর্জন সম্ভব তা করে দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান প্রশাসন। সদিচ্ছার অভাবেই যে এতদিন বৈশ্বিক র্যাংকিংগুলোতে পিছিয়ে থাকতো তা এখন স্পষ্ট হয়েছে।
কিউএস র্যাংকিংয়ে প্রথমবারের মতো ডাটা সাবমিট করে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। র্যাংকিংয়ে ১২০১ থেকে ১৪০০ -এর মধ্যে অবস্থান করে এ বিশ্ববিদ্যালয়। দেশে যৌথভাবে হয়েছে পঞ্চম। ৫ জুন রাতে র্যাংকিং মূল্যায়নকারী এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওয়েবসাইটে তথ্যটি প্রকাশ করে।
গত বছরও এই র্যাংকিংয়ে নাম ওঠানোর স্বপ্ন অধরাই ছিল। তবে স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। লক্ষ্য অর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্বব্যাপীই কিউএসের র্যাংকিংকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিংয়ে ভালো করতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাটা সাবমিট করতে হয়। নতুবা তালিকায় নাম আসে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের সদিচ্ছার ফলে গত বছর ডাটা সাবমিট করা হয়েছিল। ডাটা সাবমিট করেই র্যাংক করে রাবি। কিউএস র্যাংকিংয়ে বর্তমান অবস্থান থেকে আরও উন্নতি করতে বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে বলে জানা গেছে।
৯টি সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মান নিরূপণ করে কিউএস। সূচকগুলো হলো অ্যাকাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, কর্মসংস্থান, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষকের অনুপাত, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং স্থায়িত্ব।
কিউএসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অ্যাকাডেমিক খ্যাতি সূচকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার গুণগত মান, সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা ও গবেষণার প্রভাব দেখা হয়। ‘চাকরির বাজারে সুনাম’ সূচকে দেখা হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরা কতটা নিয়োগযোগ্যতা অর্জন করেছেন? শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতিতে প্রতিষ্ঠানটিতে কতটা গবেষণা হয়, তা দেখা হয়। সঙ্গে গবেষণার বাজেট ও প্রতিষ্ঠানের আকারও বিবেচনায় থাকে।
কর্মসংস্থান সূচকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার স্নাতকদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগযোগ্যতা কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছে, তা মূল্যায়ন করে কিউএস। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া ও প্রভাব রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্নাতকদের কতটা শিক্ষা দিতে পারছে, তা-ও মূল্যায়ন করা হয় এ সূচকে। এ ক্ষেত্রে দুটি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়। একটি হচ্ছে স্নাতকদের কর্মসংস্থানের হার। এতে দেখা হয়, প্রতিষ্ঠানটির কত শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করার ১৫ মাসের মধ্যে কর্মজীবনে প্রবেশ করছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে অ্যালামনাইদের প্রভাব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমাজে অর্থপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারছেন, একটি প্রতিষ্ঠানের এমন প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের রেকর্ড দেখা হয়। এ জন্য ব্যবসা, রাজনীতি, উচ্চশিক্ষা ও দাতব্যকাজে যুক্ত ৮২ হাজারের বেশি স্নাতকের প্রোফাইল যাচাই করে তাঁরা কোথায় উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তা দেখা হয়।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধান এবং আরও বড় পরিসরে গবেষণাকে পৌঁছে দিতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা-সহযোগিতা কতটা জোরদার করতে পেরেছে, তা মূল্যায়ন করা হয় আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক সূচকে। কিউএস র্যাংকিংয়ে স্থান করে নিতে উপর্যুক্ত সূচকগুলো মাথায় রেখে আগাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমবারের মতো তথ্য সাবমিট করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি; পাওয়া গেছে সফলতাও।
র্যাংকিংয়ে আগোনোর উদ্যোগ
আন্তর্জাতিক প্রায় সকল র্যাংকিংয়েই নাম এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এবার কাজ হবে এসব র্যাংকিংয়ে নিজেদের অবস্থান মজবুত করা। তারই লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে পরবর্তী বছরে প্রকাশিতব্য র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে যাবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
২০২২ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে ‘গোয়িং গ্লোবাল এশিয়া প্যাসিফিক’ কনফারেন্সে অংশ নিতে ৪ দিনের সফরে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার। সেখানে টাইমস হায়ার এডুকেশন-এর গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক মহাব্যবস্থাপক রীথিন মালহোত্রার সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এসময় তাঁরা রাবির র্যাংকিং বৃদ্ধির মাধ্যমে কীভাবে একে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেন। ক্রমপর্যায়ে জাতীয় পর্যায়ে মানবৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাবির র্যাংকিং বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উভয়পক্ষ একমত হোন। এছাড়া ‘গ্র্যাজুয়েট রিলেশনস অফিস’ নামে একটি অফিস খোলা হবে। যার কার্যক্রম কিউএস র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থান অর্জন করতে সহায়তা করবে।
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না আসার কারণ জানতে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস অব দি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক অধ্যাপক মো. আজিজুর রহমানের সাথে। এ বিষয়ে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, র্যাংকিং প্রকাশকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে কেবল কিউএস ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন তথ্য সাবমিট করতে হয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা নিজেরাই অনলাইন থেকে কালেক্ট করে থাকে। তাই বিগত বছরগুলোতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু এই দুই প্রতিষ্ঠানে তথ্য সাবমিট করত না তাই এই র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসতো না। তবে বর্তমান প্রশাসন এ বিষয়ে খুবই উদ্যোগী। তাঁরা খুবই আগ্রহের সাথে র্যাংকিংয়ে ভালো করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
‘র্যাংকিংয়ে ভালো না করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কোনটা ভালো তারা সেটা জানে। তাই র্যাংকিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা সরকার এ বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে বর্তমানে সরকার ও ইউজিসি থেকে তাগিদ দিচ্ছে র্যাঙ্কিং নিয়ে কাজ করার জন্য। এখন সকল ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং নিয়ে কাজ করছে।’, অধ্যাপক আজিজ যোগ করেন।
‘র্যাংকিং নিয়ে বর্তমানে আপনারা কী কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিউএস র্যাংকিংয়ে ভালো করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ‘কর্মসংস্থান’ কিউএস র্যাংকিংয়ের অন্যতম একটি সূচক। এই সূচকে ভালো করার জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট রিলেশনস অফিস’ নামে একটা অফিস খোলার জন্য সিন্ডিকেট সভায় পাশ হয়েছে। যারা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বের হচ্ছে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা এবং দেড় বছরের মধ্যে কতজন চাকরি পেল তার ডেটা সংরক্ষণ করাই হবে এই অফিসের কাজ। খুব শীঘ্রই অফিসটির কাজ শুরু হবে।
তিনি আরে বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক খ্যাতি’ ও ‘চাকরির বাজারে সুনাম’ এই দুই সূচকে ভালো করার জন্য আমরা ইতোমধ্যে ৪০০ জন অ্যাকাডেমিশিয়ান ও ৪০০ জন ইমপ্লয়ারের সাথে যোগাযোগ করেছি। তাদের সম্মতি নিয়ে ই-মেইল সংগ্রহ করেছি। সেগুলো কিউএস কর্তৃপক্ষের কাছে সাবমিট করতে হবে। যা কিউএস র্যাংকিংয়ে ভালো করার জন্য ফলপ্রসূ হবে।
তবে একটু হতাশা ব্যক্ত করে এই অধ্যাপক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, টাইমস হায়ার এডুকেশন ইমপ্যাক্ট র্যাংকিংয়ের জন্য অনেক তথ্য রেডি করতে হয়। এসব ডেটা প্রস্তুত করা খুব কঠিন কাজ। অনেক তথ্যই আমাদের কাছে নেই। অনেক বিষয়ের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্পষ্ট পলিসি নেই, সেগুলোর তথ্যও দরকার হয়। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রার সাথে আমাদের গবেষণাগুলোকে কানেক্ট করতে হয়; কোন গবেষণা কোন লক্ষ্যমাত্রাকে কাভার করে তা উল্লেখ করতে হয়। আর এগুলো সময়ের ব্যাপার। তবে আমরা ধীরে ধীরে এগুলো নিয়ে কাজ করব।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা আমাদের জন্য সত্যিই আনন্দের ও গৌরবের। আন্তর্জাতিক র্যাংকিং নিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন মনোযোগ দিয়েছে এবং উদ্যোগী হয়েছে। সেটার ফলাফলও দৃশ্যমান হচ্ছে এখন। টাইমস হায়ার এডুকেশন, কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ও ইউএস নিউজ বেস্ট গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিসহ ৭টিতে আমরা স্থান অর্জন করেছি। র্যাংকিংয়ে ভালো করতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। আশা করছি, আগামীতে এসব র্যাংকিংয়ে আমরা ভালো একটা অবস্থানে যাব।