অনিয়মের তথ্য দেওয়া ব্যক্তিকে খুঁজছে ইউজিসি

ইউজিসি
ইউজিসি  © ফাইল ছবি

বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) ঘটা অনিয়মের তথ্য দিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে। শ্বেতপত্রটি একটি ইমেইলের মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়সহ একাধিক দপ্তর ও গণমাধ্যমকর্মীদের পাঠানো হয়। এসব অনিয়মের তথ্যদাতাকে খুঁজছে ইউজিসি। এজন্য বাংলাদেশ টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি ইউজিসি সচিব ড. ফখরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি টেলিযোগযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মহাপরিচালককে পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃপক্ষ ও কমিশনের বিভিন্ন কর্মকর্তার ই-মেইলে N Islam 54925094@gmail.com> E-mail ID থেকে একটি ই-মেইল করা হয়েছে। কমিশনের কাজের স্বার্থে N Islam<54925094@gmail.com> E-mail ID ধারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করা প্রয়োজন ।’

এতে আরও বলা হয় ‘N Islam 54925094@gmail.com> E-mail ID ধারী ব্যক্তিকে শনাক্তপূর্বক তার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যাদি প্রেরণ করে কমিশনের কাজে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ থাকলে সেটি সরাসরি আমার কাছে করার সুযোগ রয়েছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এভাবে বিভিন্নজনকে ইমেইল করায় ইউজিসির কাজের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কে এ ধরনের তথ্য দিচ্ছে তা বের করতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

কী আছে অনিয়মের শ্বেতপত্রে?
শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) নিয়োগ, পদোন্নয়ন, কিংবা লোভনীয় দপ্তরে পদায়নসহ সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন এসব কর্মকর্তা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে ফের পদোন্নয়ন নিয়েছেন কমিশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।

এমনকি কম্পিউটার অপারেটর বা তৃতীয় শ্রেণির অন্য কোনো পদে কর্মচারী হিসেবে যোগ দিয়ে অনেকেই পদোন্নতি নিয়ে হয়ে গেছেন তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা। যেটি ইউজিসি প্রবিধানমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যার ফলে প্রশাসনিক অরাজকতা তৈরি হয়েছে ইউজিসিতে।

শ্বেতপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইউজিসিতে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রথম শ্রেণির পদে উন্নীতকরণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে দুটি অফিস আদেশের মাধমে। এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউজিসি’র ১৫৬তম পূর্ণ কমিশন সভায় নিয়োগ, পদোন্নয়নে অনিয়ম উদঘাটনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি ২০০৪ ও ২০০৮ সালের নিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সকল নথিপত্র পর্যালোচনা করে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে।  

পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১০ জন এবং ৩৪ জন ২য় শ্রেণির কর্মকর্তাকে ইউজিসির সার্ভিস রুলের নির্ধারিত যোগ্যতার ব্যতয় ঘটিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রথম শ্রেণির পদ দেওয়া করা হয় এবং তা ভূতাপেক্ষ (২য় শ্রেণির ১০ গ্রেডের পদে যোগদানের তারিখে) অনুমোদন দেয়া হয় যা কমিশনে বিদ্যমান প্রবিধান, নিয়োগ ও নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

এ নিয়ম বহির্ভূত নিয়োগের ফলে ইউজিসিতে প্রথমবারের মত অধিক সংখ্যক কর্মকর্তাকে অযৌক্তিক সুবিধা প্রদান করা হয়। যার ফলে কমিশনের স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা, ও ভাবমূর্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষুন্ন হয় এবং সুযোগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছু কর্মকতা পরবর্তী ধাপে (উচ্চতর ধাপে) পদায়িত হতে অযৌক্তিক সুযোগ পেয়েছেন। যোগ্যতার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন প্রার্থীদের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। এ অনিয়ম ও অযৌক্তিক নিয়োগের ফলে সৃষ্ট জটিলতা পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে কমিশনের স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এছাড়া যে কোনও ধাপে নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শিথিলতা সার্ভিস অ্যাক্টের পরিপন্থী বিধায় তা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে তদন্ত কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে। তবে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিগত কমিশন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং এসকল কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে উচ্চতর পদে পদোন্নয়ন ও নিয়োগ প্রদান করেছে। বর্তমান কমিশনও পূর্বের কমিশনের ধারাবাহিকতায় অবৈধ সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তাকে পুণরায় উচ্চতর পদে পদোন্নয়ন দিয়েছে।    

শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ইউজিসি’র পূর্ণ কশিনের ১৬৮তম সভায় গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, সুরাইয়া ফারহানা, মোস্তাফিজার রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, মুহিবুল আহসান, আকরাম আলী খান, রোকনুজ্জামান, আ. মান্নান, মাসুদ হোসেন, নাজমুল ইসলাম এবং শের আলী সাবরীকে অতিরিক্ত পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।


তাদের মধ্যে সুরাইয়া ফারহানা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৩৩ বছর বয়সে এডহক ভিত্তিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে ইউজিসিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালে। যদিও সে সময় চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩০ বছর। 

শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, চাকরির নির্ধারিত বয়স না থাকা সত্বেও কমিশনের চাকরি ও পরবর্তীতে উচ্চতর পদে নিয়োগ পেয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক মো. জামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন সম্পর্কে ইউজিসি'র ১৫৬তম পূর্ণ কমিশন সভায় নিয়োগ,পদোন্নয়নে অনিয়ম উদ্ঘাটনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, ‘মো. জামাল উদ্দিনকে শাখা কর্মকর্তা পদে ৫১০০-১০৩৬০/- বেতন স্কেলে ১৭-১-২০০৭ তারিখে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

০৩-১১-২০০৬ তারিখে নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্তাবলী অনুযায়ী বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সঠিক পাওয়া যায়। কিন্তু নিয়োগের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্তাবলী অনুযায়ী বয়স সর্বোচ্চ ৩২ বছর চাওয়া হয়েছিল কিন্তু বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত ২৩-১১-২০০৬ তারিখে তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর ১০ মাস ২২ দিন। সার্বিকভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাহিত শর্তাবলী অনুযায়ী তাঁর বয়স ০৭ বছর ১০ মাস ২২ দিন বেশি ছিল।’

অন্যদিকে গোলাম মোস্তফা, সুলতান মাহমুদ, মোস্তাফিজার, মোস্তাফিজুর, মুহিবুল, আকরাম ও মান্নান ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির শাখা কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের ২১ অক্টোবর এক আদেশে সুরাইয়া ফারহানাসহ মোট ৩৪ জন কর্মকর্তার পদ তাদের যোগদানের তারিখ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয় যা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ‘অনিয়ম ও অযৌক্তিক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে যোগদানের তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে তাদের চাকরি প্রথম শ্রেণির চাকরি হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব কর্মকর্তারা বিগত সরকারের আমলে প্রত্যেকেই দুটি করে পদোন্নয়ন পেয়েছেন বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হযেছে। 

শ্বেতপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু অবৈধ অফিস আদেশের কারণে ৩৪ জন কর্মকর্তা যারা বর্তমানে উপপরিচালক থেকে অতিরিক্ত পরিচালক পদে চাকরি করছেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদের পদোন্নয়ন হলে  ১০ বছর ও ১৬ বছর চাকরি সমাপণান্তে দুটি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে বেতন স্কেলের ৮ম গ্রেড প্রাপ্ত হতেন। সে ক্ষেত্রে চাকরি জীবনের শেষদিকে বর্তমান বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে বেতন পেলেও তা ৫৫ হাজার ৪৭০ টাকা হত। 

অথচ অবৈধ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ এখন বেতন পাচ্ছেন ৭৪ হাজার টাকা স্কেলে। প্রত্যেক কর্মকর্তা প্রতিমাসে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত বেতনের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন সরকারি কোষাগার থেকে বেশি নিচ্ছেন। চাকরিজীবনে বেতন ও চাকরিকাল শেষে পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ একজন কর্মকর্তা কমপক্ষে দেড় কোটি টাকার অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে বিধি বহির্ভূতভাবে নিয়ে যাবেন।

 


সর্বশেষ সংবাদ