নতুন পেনশন স্কিম অগ্রহণযোগ্য হওয়ার ৪ কারণ জানাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক

  © লোগো

সরকার ঘোষিত সার্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয়কে বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে এর প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে টানা আন্দোলনে নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। পহেলা জুলাই থেকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে দেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের পূর্বঘোষিত আন্দোলন শুরু করায় সেশনজটের চাপে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

আজ বুধবার (৩ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলছে, অংশীজনের সাথে কোনোরূপ আলোচনা-পরামর্শ ছাড়াই এই নতুন পেনশন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া বর্তমান সরকারের স্বেচ্ছাচারী আচরণের আরও একটি নগ্ন প্রকাশ। একদিকে সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে কেউ কেউ সীমাহীন লুটপাট করছে, দেশের ব্যাংক লোপাট করে বিদেশে মূলধন পাচার করছে, অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অবৈধ টাকার পাহাড় তৈরি করে সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। সরকারকে এসবের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না, বরং দেখা যায় জনগণের ওপর তথাকথিত উন্নয়নের ব্যয় চাপাতে। সরকার যে উন্নয়নের দাবি করে সেই দাবি সত্য হলে পেনশনের সুবিধা বাড়ার কথা, কমার কথা নয়। অথচ উন্নয়নের জৌলুসের দাম মেটাতে সরকার নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করছে জনগণকে উল্টো বিদ্যমান সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদ্যমান পেনশনের সুবিধা উঠিয়ে দিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নামের এক নতুন ব্যবস্থা চালু করা সরকারের আর্থিক ঘাটতি পূরণ করার অন্যতম একটি কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বিবৃতিটিতে অনলাইনে স্বাক্ষর করেছেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৭ জন শিক্ষক। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই নতুন পেনশন ব্যবস্থাকে শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যমূলক এবং সুবিধাহীন বিবেচনায় বাংলাদেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ১৬ হাজারের বেশি শিক্ষক এবং প্রায় ৩৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এই 'প্রত্যয়' পেনশন স্কিম প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এই দাবির পক্ষে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন। এই দাবির ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক 'প্রত্যয়' পেনশন স্কিম চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন পেনশন ব্যবস্থা 'প্রত্যয়' চালুর মাধ্যমে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার সুবিধা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। এই কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থায় মাসিক পেনশন বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষকদের বেতন থেকে নিয়মিত টাকা কাটা হবে এবং অবসরের পর কোনো এককালীন টাকা পাওয়া যাবে না। এছাড়া, নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের মনোনীত ব্যক্তির আজীবন পেনশন পাওয়ার সুবিধা থাকবে না এবং বার্ষিক পেনশন বৃদ্ধি বন্ধ থাকবে। এক হিসেবে দেখা যায় বর্তমান ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকুরি করলে অবসরজীবনে যে পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পেতে পারতেন, 'প্রত্যয়' স্কিমে যোগ দিলে সেই সুবিধা ৪০% শতাংশ কমে যাবে। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এ অবস্থায় নতুন পেনশন স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অগ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রধান ৪টি যুক্তি তুলে ধরার পাশাপাশি ৪টি দাবিও জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রধান ৪টি যুক্তি
১) অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হ্রাস: নতুন পেনশন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের বেতন থেকে নিয়মিত টাকা কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা বিদ্যমান ব্যবস্থায় ছিল না। এছাড়া, অবসরের পর এককালীন টাকা না পাওয়ায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হ্রাস পাবে। বর্তমানে শিক্ষকেরা অবসরের পর যে এককালীন টাকা পান, তা সঞ্চয়পত্র বা পেনশন তহবিলে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারেন, যা নতুন ব্যবস্থায় অসম্ভব।

২) পেনশন সুবিধার হ্রাস: বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অবসরের পর মাসিক পেনশনের পাশাপাশি বার্ষিক পেনশন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) পান। নতুন ব্যবস্থায় এই সুবিধা বাতিল করা হয়েছে, যা শিক্ষকদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলবে।

৩) মনোনীত ব্যক্তির আজীবন পেনশন: বর্তমানে শিক্ষকরা অবসরের পর তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে (স্বামী/স্ত্রী) আজীবন পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। নতুন পেনশন ব্যবস্থায় এটি ৭৫ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, যা শিক্ষকদের পরিবারের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হবে।

৪) অন্যান্য সুবিধা: বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষকদের অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি (এলপিআর) এবং অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। নতুন ব্যবস্থায় এসব সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া, উৎসব ভাতা ও চিকিৎসা ভাতার বিষয়েও নতুন পেনশন ব্যবস্থায় কোনো উল্লেখ নেই, যা শিক্ষকদের স্বার্থবিরোধী।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দাবিসমূহ
১) 'প্রত্যয়' কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য নতুন পেনশন ব্যবস্থা 'প্রত্যয়' বাতিল করে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে, যাতে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা বজায় থাকে।

২)  শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন করতে হবে।

৩) আমরা লক্ষ করেছি যে, এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর আর্থিক সামর্থ্য নেই। দরিদ্র ও মেধাবী এই শিক্ষার্থীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ শিক্ষার্থী-সহায়তা স্কিম অবিলম্বে চালু করতে হবে।

৪) শিক্ষার্থীর সংখ্যার সাথে আনুপাতিক হারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো এবং গবেষণাগার তৈরি করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ