সর্বজনীন পেনশন কেন বৈষম্যমূলক: তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে ব্যাখ্যা দিল ঢাবি শিক্ষক সমিতি
মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৩৪ PM , আপডেট: ১৯ মে ২০২৪, ০৯:০৯ PM
সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে সর্বজনীন পেনশন সংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বলে মনে করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতারা। একইসঙ্গে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তকরণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে অবনমন করার একটি অপচেষ্টা বলে মনে করেছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সর্বজনীন পেনশন যে একটি নীল নকশা-গুণগত, পরিমাণগত তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আমরা তা জাতির কাছে তুলে ধরছি। রবিবার (১৯ মে) শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূইয়া ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা স্বাক্ষরিত এক মূল্যায়ন রিপোর্টে সর্বজনীন পেনশন কেন বৈষম্যমূলক তার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
মূল্যায়ন রিপোর্টে বলা হয়, প্রথমেই আমরা পরিমাণবাচক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রত্যয় স্কিম কেন গ্রহণযোগ্য নয় তার উপর আলোকপাত করছি। এক্ষেত্রে আমাদের অনুমিত শর্ত হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বর্তমান প্রজন্ম হতে আরো অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। দ্বিতীয়ত, নতুন পদ্ধতি অবশ্যই প্রচলিত পদ্ধতি হতে অধিকতর সমান সুবিধা প্রদানে সমর্থ হবে। তৃতীয়, নতুন পদ্ধতি অর্থাৎ প্রত্যয় স্কিম যদি প্রচলিত সুবিধার চেয়ে কম সুবিধাদি প্রদান করে তাহলে প্রচলিত পেনশন স্কিম চালু রাখা। শুরুতে পরিমাণবাচক তথ্য উপস্থাপনের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে বিবেচনা করতে পারি। একজন অধ্যাপক অবসরে গেলে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় কি কি সুবিধা পান তা উপস্থাপন করা হলো।
একইসঙ্গে প্রস্তাবিত ও আদেশ জারিকৃত প্রত্যয় স্কিম' কি কি সুবিধাদি প্রদান করবে তাও উপস্থাপন করা হলো। তুলনামূলক চিত্র হতে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারব প্রত্যয় স্কিম বিদ্যমান পেনশন স্কিমের তুলনায় স্বাভাবিক না নিকৃষ্ট—
১) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক যখন অবসরে যান অবসর সময়কালীন তার মূল বেতন থাকে ৭৮ হাজার টাকা। বিদ্যমান পেনশনে তার বেতন হতে পেনশন বাবদ কোন অর্থ কর্তন করা হয় না। প্রত্যয় স্কিমে মূল বেতনের ১০ শতাংশ কর্তন করা হবে। সমপরিমাণ প্রতিষ্ঠান দিবে। অর্থাৎ, মাসিক পেনশন হিসাবে প্রত্যয় স্কিম হতে অবসরকালীন যা পাবেন তার অর্ধেক আপনার নিজের কিন্তু বিদ্যমান পেনশনে অবসরকালীন যা পাবেন তার পুরোটাই সরকারের। অঙ্ক কষলে বুঝা যাবে 'প্রত্যয় স্কিমে' সরকারি অংশটুকু কত।
২) একজন ছাত্র পাশ করার পর ৩০ বছরেও যদি শিক্ষকতায় যোগদান করে তার চাকরিকাল দাঁড়ায় ৩৫ বছর। ধরে নিলাম সে মাসিক ৫ হাজার টাকা মূল বেতন হতে কর্তন করে বাকি ৩৫ বছরের জন্য। সে হিসাবে মোট কর্তনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ লাখ টাকা। বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় মোট কর্তনের পরিমাণ শূন্য ।
৩) বর্তমানে একজন অধ্যাপক বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় বা প্রত্যয় স্কিমে এককালীন আনুতোষিকের পরিমাণ শূন্য।
৪) মাসিক পেনশন ও অন্যান্য ভাতাদি যুক্ত করলে একজন অধ্যাপক মাসিক ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা পান বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায়। প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে ৩০ বছর পর পাবেন মাসিক ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা, যার অর্ধেক অর্থাৎ ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা নিজের বেতন হতে কর্তনের জন্য।
৫) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় এককালীন আনুতোষিক যদি ১০ শতাংশ হারে পেনশন ফান্ডে অথবা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তাহলে মাসিক পেনশন দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৬৫ টাকা (৬৭,২৭৫+৪৫,৭৯০)। অর্থাৎ, বিদ্যমান প্রচলিত সুবিধা অর্ধেক করার প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চালু করার নীরব ষড়যন্ত্র চলছে।
৬) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় পেনশনার ও নমিনি আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে পেনশনার যদিও আজীবন পেনশন প্রাপ্ত হবেন। কিন্তু, পেনশনারের যদি কোন কারণে মৃত্যু হয় তবে নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ বৎসর পূর্তি পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্ত হবেন। এক্ষেত্রে নমিনি বৃদ্ধ বয়সে একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। আবার নমিনিও যদি পেনশনার হন, তাহলে উনি কি ডাবল বেনিফিট পাবেন কি না তা নিশ্চিত নয়। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় ধরে নিতে পারি এক সময় সকল বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ সর্বজনীন পেনশনে থাকবেন।
৭) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় নিট পেনশনের উপর ৫ শতাংশ হারে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট শূন্য যা বাস্তবিক নয়। পেনশনারের ক্রয়ক্ষমতাকে বিবেচনায় না নিয়ে প্যাকেজসমূহ তৈরি কোনোভাবেই বাস্তবিক নয় এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান পেনশন স্কিমের সাথে প্রত্যয় স্কিম সাংঘর্ষিক।
৮) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বর্তমানে একজন অধ্যাপক কমপক্ষে ১ লাখ ১৩ হাজার ৬৫ টাকার মাসিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ভবিষ্যতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে তা বর্তমান পেনশন গ্রহীতার তুলনায় অতি নগণ্য। এ যে কারণে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় ।
৯) বিদ্যমান পেনশনে অর্জিত ছুটি অবসরকালীন জমা থাকলে তার পরিবর্তে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। অতএব বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সাথে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করছে বলে প্রতীয়মান হয়।
১০) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় একজন এলপিআর সুবিধা প্রাপ্ত হন। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে এ বিষয়ে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এলপিআরের অর্থ বিবেচনায় নিলে বিদ্যমান পেনশন স্কিম হতে প্রাপ্ত সুবিধা প্রত্যয় স্কিমের তুলনায় আরো অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়।
১১) বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদকাল ৬৫ বছর, কর্মকর্তাদের ৬২ বছর এবং কর্মচারীদের ৬০ বৎসর পর্যন্ত। প্রত্যয় স্কিমে অবসরকালীন বয়স স্থির ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বয়সসীমা কত হবে বা প্রত্যয় স্কিমে কিভাবে সামঞ্জস্য আনা হবে এ ব্যাপারে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এতে প্রতীয়মান হয় বিশদ বিশ্লেষণ ছাড়া প্রত্যয় স্কিম চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
১২) বিদ্যমান পেনশন স্কিমে মাসিক পেনশনের সাথে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, বছরে দু’টি উৎসব ভাতা ও ১টি বৈশাখী ভাতা প্রদান করা হয় যা অর্থমূল্যে অনেক। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় প্রত্যয় স্কিম প্রকল্পে এসব কোন কিছুই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। প্রত্যয় স্কিম অন্যান্য স্কিমের মতই বিবেচনা করা হয়েছে। যার ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৩) প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থায় পিএফ থেকে ১০ শতাংশ কর্তন করা হয় কিন্তু পেনশন বাবদ কোন অর্থ কর্তন করা হয় না। বর্তমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে ১০ শতাংশ হারে পিএফ চালু রাখতে হবে এবং ১০ শতাংশ হারে বা ৫ হাজার টাকা যা কম তা কর্তনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ, চাকরির শুরুর দিকে ২০ শতাংশ কর্তন চাকরিজীবীদের জন্য বোঝা হয়ে যায় কিনা তা ভাবনার বিষয়। এ থেকেই প্রতীয়মান প্রত্যয় স্কিম প্রচলিত পেনশন স্কিমের তুলনায় ভবিষ্যৎ কর্মজীবীদের অবসরোত্তর জীবন যাত্রায় কতটুকু ভূমিকা রাখবে।