সেদিন শাবিপ্রবির শহীদ রুদ্র সেনের সঙ্গে যা ঘটেছিল

রুদ্র সেন
রুদ্র সেন  © টিডিসি

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয় গত ১৮ জুলাই। এদিন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে খাল পার হতে গিয়ে ডুবে প্রাণ হারান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী শহীদ রুদ্র সেন। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় গুরুতর আহত হন রুদ্র। 

সেদিন দিনভর পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় গেট থেকে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে নিয়ে যায় পুলিশ। রুদ্র শুরু থেকেই আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থাকায় পুলিশের টিয়ার গ্যাস লাগে চোখে। পরে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে রাস্তায় পড়ে গুরুতর আহত হন রুদ্র। 

প্রত্যক্ষদর্শী রুদ্রের বন্ধু শাহরিয়ার জামান সিয়াম তার এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘রুদ্রসহ আমরা ৯ জন সুরমার এক বাসায় থাকতাম। রুদ্র একদম শুরু থেকেই কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল। এমন কোনো দিন নাই যে সে আন্দোলনে যায় নাই। সে আমাদের বলত, আমরা দেশে থাকি বা বাইরে চলে যাই, দেশ তো আমাদেরই। দেশের সমস্যায় তো আমাদেরই এগিয়ে আসা লাগবে। সে  আমাদের উৎসাহ দিয়েছে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য। আমরা সবাই তার উৎসাহতেই আন্দোলনে যুক্ত হই। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই তারিখেও রুদ্র এবং আমরা বাসার সবাই আন্দোলনে যাই। আমরা সবাই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। সেদিনই পুলিশ বিনা উস্কানিতে  আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড মারে। এ সময় রুদ্র আন্দোলনের একদম সামনেই ছিল। তখন রুদ্রের চোখে টিয়ার গ্যাস লাগে এবং পুলিশের ধাওয়ায় রুদ্র রাস্তায় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে আরেক বন্ধু কোনোমতে ধরে বাসায় নিয়ে আসে। সে আহত ও দুর্বল হয়ে  বাসায় বিশ্রাম নেয়।’

আরও পড়ুন: ৪৮তম বিসিএসে অংশ নিলেন ৪১ হাজার প্রার্থী

তিনি আরও লেখেন, ‘সেদিন সারা দিনই পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় এবং আন্দোলনকারীদের পর্যবেক্ষণ করার জন্য ড্রোন ও পাঠানো হয় বিভিন্ন জায়গায়। পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্রলীগ। তারাও রাস্তায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর আমরা বাসার সবাই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমরা বাসার সবাই আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগ আমাদের বাসায় রাতে হামলা করতে পারে এই ভয় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা সিনিয়র কোনো ভাইয়ের বাসায় যাব। নিজেদের বাসায় থাকা সেইফ না। মাথায় ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে আমরা বাসা থেকে যখন বের হই, তখনো পুলিশের হামলা চলছিল প্রধান সড়কে। একদিকে পুলিশের হামলা চলছে ও অন্যদিকে ছাত্রলীগ থাকতে পারে, এই ভেবে আমরা প্রধান সড়কে না গিয়ে সুরমা ৬ নং রোড দিয়ে বাগবাড়ী যাওয়ার জন্য যাই। সেখানে শেষ মাথায় একটা গভীর ময়লা খাল ছিল যেটা পার হয়ে বাগবাড়ী যাওয়া লাগবে। সেখানে স্থানীয়রা ভেলা দিয়ে যাতায়াত করতো। আমি, রুদ্র সেন, আনন্দ ও সাজিদ আমরা যখন ভেলা দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই একটু দূরে যাওয়ার পর ভেলা ভারসাম্যহীন হয়ে আমরা পানিতে পড়ে যাই। এরপর আশপাশে আবার তাকিয়ে দেখি রুদ্রকে দেখা যাচ্ছে নাহ। সে সাঁতার জানত না এবং সে যেহেতু পুলিশের হামলায় আহতও ছিল হাত পা ও আর নাড়তে পারে নাই। পড়ার সাথে সাথেই পানিতে ডুবে যায়। পরে স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর রুদ্রকে পাওয়া যায় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।’

আরও পড়ুন: ‘ও সেদিন আমার জামা পড়ে বের হয়েছিল’—মুগ্ধকে নিয়ে ভাই স্নিগ্ধর বেদনাঘন লেখা

জানা যায়, রুদ্র দিনাজপুর সদর উপজেলার সুবীর সেন ও শিখা বণিক দম্পতির ছেলে। বড় বোন সুস্মিতা সেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

মৃত্যুর পর রুদ্রের বোন সুস্মিতা সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন ছিল সে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। অনেক পত্রিকায় খবর এলো, কিন্তু রুদ্র আর তো আসবে না। ছোট থেকেই শান্ত প্রকৃতির ছিল সে। ৬০ বছর বয়স মায়ের। ৭০ বছর বয়সী বাবা। তাদের সন্তান হারানোর শোকের কথা কোন শব্দে বলি। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের বড় করে মা-বাবা অনেক স্বপ্ন দেখেছেন।’


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!