এইচএসসিতে শহীদদের কৃতিত্বে আনন্দের বদলে শোকের অশ্রু

ওপরে ডান থেকে পান্থ, আফনান, নাফিসা/ নিচে ডান থেকে সবুজ, রায়হান, শাহরিয়ার
ওপরে ডান থেকে পান্থ, আফনান, নাফিসা/ নিচে ডান থেকে সবুজ, রায়হান, শাহরিয়ার  © সম্পাদিত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এমন অনেকেই শহীদ হয়েছেন যারা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আনন্দের এসব খবরে উচ্ছ্বাসের বদলে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে শহীদদের সহপাঠী, পরিবার ও স্বজনদের মধ‍্যে। যাদের নিয়ে আনন্দ উদযাপন করার কথা ছিল তারা নেই, আজ হারিয়ে গেছে চিরতরে। তবে তারা চলে গিয়েও রেখে গেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

নাফিসা হোসেন মারওয়া

সাভারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিহত শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.২৫ এ উত্তীর্ণ হয়েছেন। ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সম্মুখ সারিতে ছিলেন। গত ৫ আগস্ট দুপুরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন থানা রোডে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি।

নাফিসার বাবা বলেন, মেয়ের যাতে লেখাপড়া নষ্ট না হয়, সেই জন্য রান্না করতে দিতাম না। চায়ের দোকান দিয়ে যা দুই টাকা উপার্জন করেছি, মারওয়ার লেখাপড়ায় দিয়েছি। মেয়ে আমাকে না জানিয়ে ১৮ জুলাই থেকে উত্তরায় যেত আন্দোলনে। সারাদিন দোকানে থাকায় খোঁজ পেতাম না। প্রতিবেশীর কাছে জেনে মেয়েকে ঘরে আটকাই রাখি। আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে খুব রাগ করেছিলাম। তবে মেয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে। ৩ আগস্ট বলল, লেখাপড়া নেই, ঘরে থেকে দমবন্ধ লাগছে। সাভারে মামার বাসায় বেড়াতে যাবে। ভেবেছিলাম, সাভারে গেলে আন্দোলনে যাবে না।

সাদ আল আফনান পাটওয়ারী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাদ আল আফনান পাটওয়ারী চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের বাঞ্চানগর গ্রামের বাস টার্মিনাল এলাকার মৃত সালেহ আহমেদের ছেলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আফনান। 

আফনানের মা নাছিমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আফনানের ভালো ফলাফল আমার কাছে খুশির খবর। কিন্তু যাকে নিয়ে আমি খুশি উদযাপন করবো, সে তো আমার কাছে নেই। গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার কোল শূন্য করে দিয়েছে।

মাহাদী হাসান পান্থ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মাহাদী হাসান পান্থ। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় তিনিও জিপিএ-৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় ছাত্রজনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে সেদিন সন্ধ্যায়ই মৃত্যুবরণ করেন সরকারি তোলারাম কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহাদী হাসান পান্থ।

শাহরিয়ার বিন মতিন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহ বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়েছেন। গত ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়। শাহরিয়ারের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কুমড়াশাসন উত্তরপাড়া গ্রামে।

শাহরিয়ারের বাবা মোহাম্মদ আবদুল মতিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী আমার একমাত্র ছেলে কলিজার টুকরা শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন (Sheikh Shahriar Been Matin) এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।’

আরও পড়ুন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শাহরিয়ার পেলেন জিপিএ-৪.৮৩

মো. রায়হান

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে রাজধানীর বাড্ডায় বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী মো. রায়হান। মিছিলে হঠাৎ মাথায় ও পিঠে গুলি এসে লাগে তার। শহীদ হন গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী রায়হান। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। তার ফলাফল দেখে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ রায়হানের মা-বাবা।

রায়হানের মা আমেনা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে বেঁচে নেই, তার এই ফল দিয়ে কী হবে? সে পাস করসে তা দিয়ে এখন কি করব। তার আরও ভালো রেজাল্ট করার কথা। সে মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা এখনও কান্না করছেন। নিজেরা না খেয়ে সন্তানকে খাইয়েছি। তাকে ঢাকায় পড়ালেখা করাইসি। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন বুলেটে শেষ হয়ে গেছে।’

রায়হান নোয়াখালীর সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের পূর্ব দুর্গানগর গ্রামের আমজাদ হাজী বাড়ির মো. মোজাম্মেল হোসেন ও আমেনা দম্পতির একমাত্র ছেলে।

গুলশান কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ এম এ কালাম বলেন, ‘আমাদের কলেজ থেকে এ বছর রায়হানসহ ৩৯৪ জন বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। তারমধ্যে ৩৮১ জন পাস করেছে। রায়হান জিপিএ ২.৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার ফলাফল আরও ভালো হওয়ার কথা। কিভাবে এত খারাপ হলো তা আমাদের জানা নেই। তবে তার মৃত্যু আমাদের এখনও কাঁদায়। সরকার যেন তার পরিবারের সঙ্গে থাকে সে আশা করছি।’

সবুজ মিয়া

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেরপুরে শহীদ সবুজ মিয়া এইচএসচি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এইচএসসির প্রকাশিত ফলাফলে জানা যায়, শ্রীবরদী সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে তিনি জিপিএ- ৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। গত ৪ আগস্ট শেরপুর জেলা শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহীদ হন সবুজ মিয়া।

সবুজ মিয়া শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের রুপারপাড়া গ্রামের আজহার আলীর ছেলে। তার কৃতকার্যের খবরে পরিবার, শিক্ষক ও সহপাঠীদের মাঝে আনন্দের পরিবর্তে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।


সর্বশেষ সংবাদ