কোরবানির ফাযায়েল-মাসায়েল ও আমাদের করণীয়
- মু. নূরুল্লাহ
- প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০৪:০৫ PM , আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫, ১১:০১ PM
কোরবানি ইসলামের অন্যতম একটি মহান ইবাদত ও সুন্নাতে ইব্রাহিমী, যা শুধু পশু জবাইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি ঈমান, ত্যাগ, তাকওয়া, আত্মসমর্পণ ও ভালোবাসার চূড়ান্ত প্রকাশ। এই ইবাদতের মূল শিক্ষা হচ্ছে—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করা, উৎসর্গ করা। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর ঈমানদীপ্ত ঐতিহাসিক আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণ স্মরণে প্রতিবছর মুসলিম উম্মাহ কোরবানির মাধ্যমে তাদের অনুসরণ করে। আমাদের প্রয়োজন কুরআন ও হাদীসের আলোকে কোরবানির উদ্দেশ্য, নিয়ম ও শিক্ষা উপলব্ধি করে তা যথাযথভাবে পালন করা।
কোরবানির আদি ইতিহাস
কোরবানির সূচনা হয় হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে আদেশ করেছিলেন—“তোমার প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে আমার পথে কোরবানি করো।” ইব্রাহিম (আ.) কোনো প্রশ্ন না করে আল্লাহর আদেশ পালনে প্রস্তুত হন এবং ইসমাঈল (আ.)-ও আল্লাহর আদেশে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মত্যাগ দেখে আল্লাহ খুশি হয়ে ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। তখন থেকেই মুসলমানরা এই ত্যাগের স্মরণে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ পশু কুরবানী করে আসছে। তবে পশু কুরবানী প্রকৃতপক্ষে আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) দু’ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানির মাধ্যমেই প্রচলিত হওয়া ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
কোরবানির ফাযায়েল (গুরুত্ব ও মর্যাদা)
কুরআনুল কারিমে কোরবানির গুরুত্ব:
(ক) তাকওয়ার শিক্ষা:
মহান আল্লাহ বলেন- “তাদের গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”- (সূরা হজ্ব: ৩৭)। এই আয়াতে কারীমাহ থেকে স্পষ্ট যে, কুরবানীর বাহ্যিক দিকের চেয়ে অন্তরের তাকওয়া ও আন্তরিকতাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
(খ) কোরবানি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত:
কুরআনের বাণী- “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি…” -(সূরা হজ্ব: ৩৪)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, “ অতঃপর আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন”– (সূরা কাউসারঃ ২)। এ সব আয়াত প্রমাণ করে যে কুরবানী শুধু ইসলাম ধর্মে নয়, বরং পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের মধ্যেও ছিল। এবং তা মহান আল্লাহর নির্দেশ।
(গ) কোরবানি একমাত্র আল্লাহর জন্য:
মু’মিনের সমস্ত কিছু কেবল আল্লাহর জন্য নিবেদিত। মহান আল্লাহর বাণী,- “(হে রাসূল) আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু শুধুমাত্র জগতসমূহের মহান প্রতিপালকের জন্য”। সুতরাং আল্লাহ নিজেই শিখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের কোরবানি হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
হাদীস শরীফে কোরবানির ফজিলত
(ক) সর্বোত্তম আমল:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কোরবানির দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো পশু কোরবানি করা।”- (সুনানে তিরমিজি)।
(খ) একেক পশুর পশম ও রোমে নেকী:
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন- “কোরবানি করা পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী লেখা হয়।”- (ইবনে মাজাহ)
(গ) সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি না করলে:
নবী (সঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।”-(ইবনে মাজাহ)।এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি না করা মারাত্মক গোনাহ। এবং এ বক্তব্যের আলোকে অনেকের মতে নিসাব পরিমাণ নয় বরং পশু কেনার সামর্থ্য হলেই কুরবানী দেয়া উচিত।
রাসূল (সঃ) আরও বলেন, “আদম সন্তানের যে কোন কাজের জন্য সে দশ গুণ সওয়াব পায়, কিন্তু কোরবানির জন্য আল্লাহ নিজ হাতে সওয়াব দেন।”- (তিরমিজি)
সাহাবায়ে কেরামের আমল
সাহাবায়ে কেরাম কোরবানিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। তারা কুরবানীর পশু পোষা শুরু করতেন কয়েক মাস আগ থেকেই। তারা কোরবানিকে আল্লাহর রাস্তায় প্রিয় বস্তু উৎসর্গের প্রতিযোগিতা হিসেবে নিতেন এবং এর জন্য গুরুত্বসহকারে প্রস্তুতি শুরু করতেন। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে,-“কোরবানির দিনে মানুষের সবচেয়ে উত্তম কাজ হলো কোরবানি করা।”
কোরবানির মাসায়েল (বিধান ও নিয়মাবলি)
(ক) কোরবানির হুকুম:
হানাফি মাযহাবে: কোরবানি ওয়াজিব। শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাযহাবসহ অনেকের মতে: সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। তবে সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালনীয়।
(খ) কোরবানির সময়সীমা:
১০ জিলহজ ঈদের নামাযের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কেবল মুসুল্লা বা ঈদগাহে ঈদের নামায আদায়ের পরই কোরবানি করা বৈধ। ঈদের সালাতের আগে কোরবানি দেয়া যায় না।
(গ) কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব:
প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম, মুকীম (অর্থাৎ মুসাফির নয়), কুরবানীর দিনগুলোতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী—এমন ব্যক্তির উপর কোরবানি ওয়াজিব।
(ঘ) কোরবানির পশুর বয়স:
কোরবানির পশুর বয়সের ক্ষেত্রে – গরু/মহিষ: কমপক্ষে ২ বছর পূর্ণ হওয়া, ছাগল/ভেড়া: ১ বছর (স্বাস্থ্যবান হলে ছয় মাসের ভেড়া দিয়েও কোরবানি হবে)
উট: ৫ বছর
(ঙ) অংশীদারিত্ব:
গরু/মহিষ বা উটে ৭ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। প্রত্যেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত থাকতে হবে।
(চ) পশুতে ত্রুটিমুক্ত থাকা উচিত:
অন্ধ, এক চোখ অন্ধ, খোঁড়া, খুব দুর্বল, কানে কাটা, লেজ কাটা ইত্যাদি ত্রুটি থাকলে তা কোরবানিযোগ্য নয়।
কোরবানির আদব ও নিয়ম
(ক) জবাইয়ের সময় করণীয়:
>পশুকে কিবলামুখী করে শোয়ানো।
>জবাইয়ের আগে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলা।
>ধারালো ছুরি ব্যবহার করা।
>এক পশুর সামনে আরেক পশু জবাই না করা।
(খ) গোশতের বণ্টন:
তিন ভাগ করা ভালো- ১. আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব, ২. দরিদ্র ও মিসকীন, ৩. নিজের পরিবারের জন্য। নিজেই পুরোটা রাখা জায়েয, তবে প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে উপভোগ করা উত্তম।
কোরবানি ও সমাজিক দায়িত্ব
(ক) দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি:
কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য সমাজের দরিদ্র শ্রেণির সাথে সুখ-সাম্যের বন্ধন তৈরি করা। অনেক গরিব পরিবার সারা বছরে একবার কুরবানীর গোশতই উপভোগ করতে পারে। তাই কুরবানী যেন শুধুমাত্র উৎসব বা প্রতিযোগিতা না হয়, বরং গরিবদের মুখে হাসি ফোটানো হোক আমাদের লক্ষ্য।
(খ) অহংকার ও লোক দেখানো থেকে বিরত থাকা:
আজকাল বড় পশু, দামি পশু, আর প্রচার-প্রচারণার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু এই ধারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের পরিপন্থী। কোরবানি একান্ত ইবাদত—তাই একে অহংকার বা প্রতিযোগিতার বস্তু বানানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(গ) পরিবেশ সচেতনতা:
জবাইয়ের স্থান পরিষ্কার রাখা, বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা, রক্ত মাটিতে ছড়িয়ে না ফেলা ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। কুরবানীর গোশত ও আবর্জনা রাস্তায় ফেলে রাখলে তা ইবাদতের মর্যাদা হ্রাস করে।
আমাদের করণীয়
(১) নিয়ত বিশুদ্ধ ও ইখলাস ঠিক করা:
আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য যেন নিয়তে না থাকে—যেমন: লোক দেখানো, সমাজে মর্যাদা অর্জন, আত্মপ্রচার ইত্যাদি। রাসূল (সঃ) বলেন, -“ প্রত্যেক আমলের ফলাফল নিয়তা অনুযায়ীই হয়”...।– (সহীহ বুখারী)
আমাদের করণীয় প্রথমেই নিয়ত বিশুদ্ধ করা। কোরবানির মূল শিক্ষা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস ত্যাগ করা। অতএব শুধু সামাজিকতা বা আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোরবানি করলে তা কবুল হবে না।
(২) ইলম অর্জন করা:
প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কোরবানির মাসায়েল নিজে শিখে নেওয়া এবং পরিবার-পরিজনকে শেখানো। ভুল মাসআলা অনুযায়ী কোরবানি করলে ইবাদত কবুল হবে না।
(৩) তাকওয়া অর্জন:
আল্লাহ তাআলা তাকওয়াকে কোরবানির আসল উদ্দেশ্য বলেছেন। তাই আমাদের উচিত কোরবানির সময় তাকওয়া অর্জনের জন্য আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মশুদ্ধি করা।
(৪) দীনদারিতা ও সুন্নতের অনুসরণ:
কোরবানির প্রতিটি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করাই আমাদের দায়িত্ব। জবাইয়ের সময় সুন্নাহ মোতাবেক আচরণ, সময় মতো জবাই, পশুর যত্ন নেওয়া, দরিদ্রদের অংশ দেওয়া এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবাই করতেন। আমরাও যেন নিজের হাতে বা অন্তত উপস্থিত থেকে এই ইবাদত পালনের চেষ্টা করি।
(৫) পরিবেশ ও প্রাণীর প্রতি সদাচরণ:
জবাইয়ের জায়গা পরিষ্কার রাখা, পশুকে অহেতুক কষ্ট না দেওয়া, অন্য পশুর সামনে জবাই না করা এসব বিষয়েও আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা যখন জবাই করো, তখন ভালোভাবে জবাই করো। পশুকে কষ্ট দিয়ো না।”- (মুসলিম)
(৬) অহঙ্কার ও অপচয় থেকে বিরত থাকা:
কোরবানিতে বড় পশু কেনা, ছবি তোলা, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা ইত্যাদি অহঙ্কারের উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া মাংস নষ্ট না করে যথাযথ বণ্টন করা জরুরি।
কোরবানি কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য, তাকওয়া ও আত্মসমর্পণের এক মহান ইবাদত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর জীবন আমাদের জন্য উদাহরণ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা কতটা ত্যাগ করতে পারি—এই প্রশ্নের উত্তরে কুরবানী আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মনিবেদন শেখায়। আসুন, আমরা কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম হিসেবে কোরবানি পালন করি এবং সমাজে দীনদারিতা, সহানুভূতি ও কল্যাণ ছড়িয়ে দিই। আল্লাহ আমাদেরকে শুদ্ধ নিয়তে কবুলযোগ্য কোরবানি করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: বি.এ (অনার্স), এম.এ; এম.ফিল, ঢাকা বিশবিদ্যালয় এবং শিক্ষক ও গবেষক