২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকেই নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পদধ্বনিতে মুখর হবে, এ স্বপ্ন দেখছি
- প্রফেসর ড. মোহাঃ হাছানাত আলী
- প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৪১ AM
সময়ের ধারা যেমন সতত বহমান, তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি, বিকাশ ও স্থিতির যাত্রাও চলে এক অনন্ত প্রবাহে। আজ যখন আমি নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে পেছনে ফিরে দেখি – সেই শুরুর দিনটি, ৭ অক্টোবর ২০২৪ – তখন মনে হয়, এই এক বছর যেন শুধু সময়ের পরিমাপ নয়, বরং এটি এক স্বপ্নের বীজ বপনের, চারা রোপণের ও তার পরিচর্যার প্রথম অধ্যায়। আর দিনটিও ছিল ভয়াবহ একটি গল্পে ভরা দিন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় এই দিনে বুয়েটের হলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে খুন করেছিল শহীদ আবরার ফাহাদকে। আমি শহীদ আবরারের মৃত্যুদিনে দায়িত্ব গ্রহণ করে মনে মনে শপথ করেছিলাম আর কোনো শিক্ষার্থীকে যেমন তারমতো করুণ পরিণতি ভোগ করতে না হয়। পাশাপাশি নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রেক্ষাপট এমনভাবে তৈরি করতে চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত স্বপ্নযাত্রার সারথি হতে পারে।
নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাবিধ সীমাবদ্ধতাকে স্বাভাবিক জেনেই আমি কাজ শুরু করেছি। ব্যক্তিগত বাহন না থাকায় অটোরিক্সায় যাতায়াত করেছি। মেট্রোরেল আর পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে গিয়ে দৈনিকের সংবাদে উঠে গিয়েছি, তাও ক্লান্ত কিংবা বিব্রত হয়নি। আমি নিরলস চেষ্টা করে গিয়েছি যেভাবেই হোক নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরু করতে। আমি আমার যোগদানের সাথে সাথেই উপলব্ধি করেছিলাম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ তার একাডেমিক কার্যক্রমে নিহিত।
সেই বিশ্বাস থেকেই আমি দেরি করিনি। যোগদানের মাত্র সাত দিনের মাথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বরাবর আবেদন করি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক একাডেমিক প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সহযোগিতা চেয়ে চ্যান্সেলর বরাবর ৭ মে ২০২৫ তারিখে পত্র প্রেরণ করি। কিন্ত বারংবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা কিংবা পাঠদানের অনুমতি প্রার্থনায় হতাশ হতে হয়েছে। কোনো একটা অজানা কারণে আমার সব প্রচেষ্টা সফলতা থেকে দূরে থাকলেও আমি চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থী ভর্তির আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার অবকাঠামো ও আনুসাঙ্গিক নানা দিক থেকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান কেন্দ্র নয়। এটি একটি সামগ্রিক সমাজ-চিন্তার প্রতিফলন, যেখানে মানুষ, প্রযুক্তি, প্রশাসন ও সংস্কৃতি সমন্বিতভাবে চলে। সেই বিবেচনা সামনে রেখে আমি কাজ শুরু করি। চেষ্টা করেছি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আমার পথচলায় সাথে নিতে যাতে তারা তাদের এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি আপন করে নেয়। তারা সবাই যাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একান্তই নিজের মনে করে।
প্রথমে আমাদের কর্মচারীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ব্র্যাক ব্যাংক নওগাঁ শাখার সহায়তায় একটি বাইসাইকেল উপহার পাই ২০ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে। হ্যাঁ, হয়তো এটি সংখ্যার বিচারে ছোট, কিন্তু এটি ছিল একটি মানবিক নজির, একটি সহমর্মিতার চিহ্ন। এর মধ্য দিয়ে তারা বুঝিয়েছিল আমাদের সঙ্গে আছে।
এরপর, দীর্ঘপ্রতীক্ষিত প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের দিকে এগোই আমরা। ১৯ নভেম্বর ২০২৪, গঠিত হয় পূর্ণাঙ্গ সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল – আমাদের প্রশাসনিক স্বরূপের প্রথম দৃশ্যমান কাঠামো। এখান থেকেই জন্ম নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিগত দিকনির্দেশনা, এখান থেকেই নির্ধারিত হয় আমাদের পথচলার ছন্দ।
শিক্ষার আধুনিকীকরণে আমি সবসময়ই প্রযুক্তিকে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে দেখি। ৩০ নভেম্বর ২০২৪, আমরা “ব্র্যাক ব্যাংক স্টাডি সেন্টার” গঠনের প্রস্তাব পাঠাই ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এরপর ৩ ডিসেম্বর, “ই-লার্নিং সেন্টার” প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক বরাবর প্রস্তাব পাঠানো হয়। এই দু’টি প্রকল্প এখনও বিবেচনায় থাকলেও আমরা আশাবাদী, এগুলো শীঘ্রই বাস্তব রূপ নেবে।
তারই ধারাবাহিকতায়, ৪ডিসেম্বর, সিটি ব্যাংক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদানস্বরূপ প্রদান করে ছয়টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ছয়টি ল্যাপটপ – শিক্ষার আধুনিক পরিসরে এই প্রযুক্তির অবদান আমাদের পাঠদানকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্য ১১ ডিসেম্বর, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান বরাবর একটি মাইক্রোবাস চেয়ে আবেদন জানানো হয়।
অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও দূরদর্শী পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই আমি গঠন করি দুটি শক্তিশালী বিভাগ: এক, অর্থ বিভাগ, এবং দুই, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ – উভয় বিভাগে একজন করে পূর্ণকালীন পরিচালক নিয়োজিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রয়োজন ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, আমরা “সমন্বিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা” এবং ৫০ বছরের একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করি। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সংশ্লিষ্ট ডিপিপি জমা দেই এবং অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাই, ৩১ জুলাই ২০২৫, সরকার এই প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে কাজ শুরুও হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল আরেকটি গর্বময় অধ্যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই অনুষ্ঠানটি কেবল একটি উৎসব নয়, বরং এটি ছিল আমাদের আত্মপরিচয়ের এক নতুন উপলব্ধি। উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় বিশেষ সহকারী ও ইউজিসির প্রাজ্ঞ সদস্যগণ – তাঁদের উপস্থিতি আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
আমাদের স্বপ্নের প্রকৃত ভিত্তি – স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ। ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করি সাইট সিলেকশনের মাধ্যমে। ৭ জুলাই ২০২৫, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠাই, এবং ২৮ জুলাই, সরকার ৯৬.৮১৬৪ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়। এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তব রূপান্তর। এর মধ্য দিয়ে শক্তিশালী অবকাঠামোর বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
শিক্ষার্থীরা আসার আগে গ্রন্থাগার সমৃদ্ধিকরণ ছিল আমার আরেকটি অগ্রাধিকার। ১৮ আগস্ট ও ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ – বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও আইবিএসের কাছে পাঠানো আবেদনের ফলে ইতিমধ্যে আশ্বাস পাওয়া গেছে গুরুত্বপূর্ণ বই প্রাপ্তির। আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ৪৮ খণ্ডের বাংলাদেশ কোড এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে ২১০টি বই পাওয়া গেছে – যা আমাদের পাঠাগারে নতুন জ্ঞানভাণ্ডার সংযুক্ত করেছে।
এই পথচলায় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নওগাঁর একজন প্রাজ্ঞ, বিদ্যোৎসাহী সমাজসেবক – জনাব মোঃ আব্দুল কুদ্দুস। তিনি আমাদের জন্য ১০০০ গ্রন্থবিশিষ্ট একটি লাইব্রেরি ও ৫০ কম্পিউটারসহ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন – যা নিঃসন্দেহে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
প্রযুক্তির উন্নয়নে আমরা পেয়েছি সনি র্যাংগস ও বেঙ্গল এয়ারলিফট লিমিটেড কর্তৃক উপহারস্বরূপ দুটি আধুনিক স্মার্ট টিভি। আর বর্তমানে আমরা যে ডিপিপি তৈরি করছি, সেখানে রয়েছে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন, ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণ – যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাস।
শুধু একাডেমিক নয়, আমি ক্রীড়াক্ষেত্রেও নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়কে সক্রিয় করে তুলতে চেয়েছি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ক্রীড়া সামগ্রী চেয়ে আবেদন করেছি – কারণ আমি বিশ্বাস করি, সুস্থ দেহেই সুস্থ মন। আর শিক্ষার্থীরা সুস্থ থাকলে তাদের মানবিক বিকাশ এবং শিক্ষার স্ফূরণ সম্ভব হবে।
নানা প্রতিবন্ধকতা আর অজানা বিপত্তিতে ভরপুর এই এক বছর ছিল শুধুই শুরুর, এটি ছিল একটি নবজন্মের পর প্রথম শ্বাস নেওয়ার মতো। প্রতিটি দিন, প্রতিটি চিঠি, প্রতিটি আবেদন ও প্রতিটি সাড়া ছিল আমাদের পথচলার একেকটি সিঁড়ি। আমি কৃতজ্ঞ—আমার সহকর্মী, প্রশাসনিক কর্মচারী, নওগাঁবাসী এবং দেশের সর্বোচ্চ মহলের প্রতি—যাঁরা এই যাত্রায় আমাদের পাশে ছিলেন। আমাদের প্রচেষ্টা দ্রুতই পূর্ণতা পেতে পারে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরুর মধ্য দিয়ে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আগামী ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকেই নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠবে। এ স্বপ্ন আমরা দেখেছি, এ স্বপ্ন আমরা গড়ছি, ইনশাআল্লাহ, অচিরেই তা বাস্তবে রূপ পাবে।
লেখক: উপাচার্য নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়।