প্রতিবন্ধীবান্ধব নয় জবির ভবন, ভোগান্তিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা
- জুনায়েদ মাসুদ
- প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০১:২৩ PM , আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০২ AM
বাংলাদেশের অন্যতম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও অবকাশ ভবনসহ কোনো ভবনেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থীদের চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা নেই। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের অভিযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে নেই র্যাম্প, লিফট বা হুইলচেয়ার ব্যবহারের উপযোগী প্রবেশপথ। কোথাও থাকলে তা ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় নেই। এমনকি অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষ ও অফিসে যাওয়ার জন্য রয়েছে দীর্ঘ সিঁড়ি, যা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতৃবৃনন্দের অভিযোগ, প্রতিবছর ভর্তি পরিক্ষায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ভর্তি-ইচ্ছুক বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় বাদ পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে প্রথমেই চলাফেরায় প্রতিকূলতার সম্মুখীন হোন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় শতাধিক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছেন। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি সুযোগ পেয়েছেন প্রায় ২৫ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী যাদের কারো শারীরিক, কারো দৃষ্টি কিংবা কারো শ্রবণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে অক্ষম এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভবন, ক্লাসরুমে চলাফেরা করতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "আমার এক সহপাঠী হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। প্রতিদিন তাকে শ্রেণিকক্ষে পৌঁছাতে অন্যদের সাহায্য নিতে হয়। নিজে কিছু করতে পারে না, অথচ এটা তো তার অধিকার।"
বোরহান নামে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক শিক্ষার্থী বলেন, "আমি এক পায়ে চলাফেরা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পর থেকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এপর্যন্ত এসেছি। অনেক অসুবিধা হয়। তবে আজ পর্যন্ত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য কোন সহায়ক কার্যকরী পদক্ষেপ দেখেনি। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে হয়ত সেই আশা পূরণ হবে। তবে তা কবে হবে সেটা জানিনা।
এ বিষয়ে শিক্ষক ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অনেকে স্বীকার করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে ‘ইনক্লুসিভ ডিজাইন’ বা প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তাদের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা নীতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এমন বৈষম্য শুধু মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন নয়, শিক্ষার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ফিজিক্যালি-চ্যালেঞ্জড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (পিডিএফ) এর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম হাফিজ ফাহিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, "বাংলাদেশের অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধকতা বেশি তা নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করবে না নিশ্চিত। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত বাঁধার কারণে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অনেকেই বোঝা মনে করে থাকে যার দরুন তাদের সাথে অনেকেই মেসে থাকতে চান না, স্বাভাবিক ভাবেই আবাসন সুবিধা না থাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তিহার এমনিতেই কম।"
ফাহিম অভিযোগ করেন,"জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সকল ফি (ভর্তি, বেতন ও অন্যান্য) মওকুফ করলেও ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে আজ পর্যন্ত তা লেখা হয়নি। এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনই সম্পূর্ণভাবে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করে না, শহীদ সাজিদ অ্যাকাডেমিক ভবনে র্যাম্প থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী।"
তিনি বলেন, "প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুযায়ী, প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে বরাদ্দের কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ, প্রশ্নপত্রের ফন্ট কিছু বড় বা ছোট করা, যথাযথ হাইলাইট/বোল্ড করার ব্যবস্থা, স্পষ্টাকার ফন্ট ব্যবহার, শ্রুতিলেখকের বিধিমালা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতে হয়। বর্তমানে অনেক শিক্ষকই দয়া প্রবণ হয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, অথচ এগুলো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অধিকার হিসেবে বরাবরই নিগৃহীত হয়ে আসছে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার সংগঠন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রাইটস সোসাইটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, জাতিসংঘের সিআরডিপি অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, চলাচল ও অংশগ্রহণে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে, সাধারণ মানুষের মতোই। তাই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তাদের জন্য সহায়ক না হয়, তা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেয়া।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. কে এ এম রিফাত হাসান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো সিটি করপোরেশন কিংবা রাজউক যে যে বিল্ডিং কোড, সেটা মেনে করা হয়নি। আমরা এটাকে এই অবস্থাতেই পেয়েছি। এখন ভবনগুলো ভেঙে ফেলা সম্ভব না। আমরা যে ৭ একর ক্যাম্পাসে নতুন ভবন তৈরি করবো সেই সুযোগও নেই। এছাড়া ইউজিসি থেকে নতুন ভবন তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা এতে বাজেট ছাড় দেবেনা। আমি মনে করি, বিকল্প হিসেবে যেটা হতে পারে তা হলো; জবি দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জগুলোকে মাথায় রেখে অবকাঠামো তৈরি করা৷ আমি ওই পরিকল্পনা কমিটিতে নেই। কিন্তু আমি আশা রাখি যারা আছেম তারা এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অল্প হলেও তারা আমাদের শিক্ষার্থী। তাদের বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি বর্তমান ক্যাম্পাসে অবকাঠামোগত পরিবর্তন না এনে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী কোন চলাচল সুবিধার জন্য কিছু করতে পারি সেটা ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের মতামত চাইবো। যদি কিছু করার থাকে তাহলে আমরা চেষ্টা করবো। তাছাড়া আমাদের বেশ কয়েকটি একাডেমিক ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য প্রশাসনের কাছেও অনুরোধ থাকবে তারা যেন একটা মনিটরিং কমিটি করে একটা কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, এই মুহূর্তে আমরা যেটা করতে পারি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য তা হলো সচেতনতা বৃদ্ধি। পিডিএফ এর মতো বিভিন্ন সংগঠন যারা এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে তারা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের করণীয় কি তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে তাদের দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ কিছুটা কমবে বলে মনে করি।
এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের এই ক্যাম্পাসে যে অবকাঠামোগুলো রয়েছে সেগুলো সংস্কার করেও আমরা চাইলে কিছু করতে পারছিনা। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে অবকাঠামো নকশা করা হবে। এবিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব।