গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়: আলোচনায় ৯ মাসে ১০ উদ্যোগ
- এস এম মোজতাহীদ প্লাবন
- প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ০৮:০৯ PM , আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫, ০৯:০৭ PM
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে বইতে শুরু করে সংস্কারের হাওয়া। সেই ধারায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলা আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনিয়ম ও দুর্নীতির ছাপ পড়ে। শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন করে জন্ম নেয়া বাংলাদেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই পরিবর্তনের ধারায় পিছিয়ে ছিল না ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকা এই বিদ্যাপীঠে নতুন গতি সঞ্চার হয় ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, যখন সপ্তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি যেন একটি ঘুমন্ত ক্যাম্পাসে প্রাণসঞ্চার করেন। নির্বিচারে নয়—পরিকল্পিত, পরিমিত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে শুরু হয় উন্নয়নের শুভযাত্রা। উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পর্যন্ত ৯ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এ আয়োজনে।
ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে নির্দিষ্ট ভিশন। তিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন মানে কেবল নতুন দালান নয়, বরং একটি টেকসই ও মানবিক পরিবেশ তৈরি করা। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব রূপ পেয়েছে একের পর এক কাজের মধ্য দিয়ে।
সত্যানুসন্ধানসহ একাধিক কমিটি
বিগত সময়ে ফ্যাসিস্টের পক্ষে থাকাদের খুঁজে বের করতে অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সিন্ডিকেট সভায় তিনটি ক্যাটাগরিতে সত্যানুসন্ধান কমিটি করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে-শিক্ষকদের অনিয়ম দেখতে একাডেমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম দেখতে প্রশাসনিক আরেকটি এবং শিক্ষার্থীদের অনিয়ম দেখতে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি এখন কাজ করছে সিন্ডিকেট সদস্যদের নেতৃত্ব। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম।
গত অক্টোবরে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পূর্বেই সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের কাছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওএমআর দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরপর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ ঘটনায় গঠিত অধিকতর তদন্ত তাদের প্রতিবেদন সাবমিট করেছে। এখন তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া গত সময়ে সাংবাদিকদের মারধরে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন এবং দর্শন বিভাগে মারধরের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটির আলোকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবন চালু হয়েছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ একটি সুসজ্জিত প্রশাসনিক কাঠামো এখন প্রশাসনিক কাজের গতি এনেছে।
শিল্প-সংস্কৃতির জন্য এক আলাদা ঘর—যেখানে কবিতা, নাটক ও চিত্রকলার মিলন ঘটে। ইতোমধ্যেই নবনির্মিত দৃষ্টিনন্দন কলা ভবনটিতে ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইতিহাস বিভাগ, দর্শন বিভাগ ও সঙ্গীত বিভাগ।
৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জন্য ৪টি হলে মোট ৪ হাজার আসন রয়েছে। এদিকে, আরও দুটি হল তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের শেষে এ হল দুটি কাজ শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন উপাচার্য। তিনি বলেন, এ দুটি হলে প্রায় আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত করা যাবে। ফলে শিক্ষার্থীদের জন্য ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আবাসনের ব্যবস্থা করা যাবে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে কমানো হয়েছে আবাসিক হলগুলোর সিট ভাড়া। যা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।
এছাড়া বন্ধন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য আধুনিক আবাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসনের ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জুলাই স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ এবং আধুনিক নজরুল ভাস্কর্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্নিবীণা ও বিদ্রোহী হলের সামনে জুলাই ৩৬ স্কয়ার নামে একটি জুলাই স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। উপাচার্য জানান, এর আগে সেখানে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ছিল। ৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীরা সেটি ভেঙে ফেললে সে জায়গায় জুলাই ৩৬ স্কয়ার করা হচ্ছে। দুয়েকদিনের মধ্যে কমিটি সুপারিশ দেবে। এরপরই কাজ শুরু হবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক নজরুল ভাস্কর্যের আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। দীর্ঘ অবহেলা আর আশ্বাসের পর এবার জাতীয় কবিকে স্মরণে রেখে মনোমুগ্ধকর একটি শিল্পকর্ম রূপে সংস্কার করা হয়েছে কবির ভাস্কর্য, যা আলোকসজ্জায় নজর কাড়ে।
গবেষণার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ
গবেষণার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টিতে ইতোমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়েছে গবেষণা মেলা। তাছাড়া গবেষণার নৈতিক মান রক্ষা ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছানোর জন্য এটি একটি যুগোপযোগী সংযোজন আইআরবি (ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ড) গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া রিসার্চ এক্সেটনশন দপ্তর এবং ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণায় ফান্ড দেওয়া হয়। এদিকে, ইউজিসি থেকে গবেষণা বরাদ্দ আনতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
এছাড়া গবেষণা বিভাগের উদ্যোগে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ক্রেডিট এক্সচেঞ্জের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান গেট ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নামফলক স্থাপন
পরিচয়ের শক্তিশালী চিহ্ন—বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যান্ডিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে কাজ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গেট দৃশ্যমান এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ফুট ওভার ব্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক বসানো হয়েছে।
উপাচার্য জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হয়। আগে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে রয়েছে সেটি বোঝা যেতো না। এখন মহাসড়কের এন্ট্রি পয়েন্টে বড় করে নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। ফলে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়টি সহজেই খুঁজে নিতে পারবে।
পরিবহণ পুলে ট্রিপ বৃদ্ধিকরণ, নিত্যদিনের ভোগান্তি লাঘব
ময়মনসিংহ শহরকেন্দ্র থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহের একটি উপশহর ত্রিশালের নামাপাড়া-বটতলায় অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ময়মনসিংহ শহরে যাতায়াতের ভোগান্তি কমাতে প্রতিদিনের শিডিউলে যুক্ত করা হয়েছে নতুন চারটি ট্রিপ। এতে করে শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের ভোগান্তি কিছু লাঘব হয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
খেলার মাঠ সংস্কার ও ফুটপাত নির্মাণ
শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির পথ সুগম করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সংস্কার করা হচ্ছে। এই সংস্কারের কাজ এখন দৃশ্যমান। তাছাড়া ক্যাম্পাসে ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে, যা হেঁটে চলার পথ পেয়েছে সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা পেয়েছে।
প্রার্থনার স্থান নির্ধারণে নানা উদ্যোগ
মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনে হাত দিয়েছে প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় মসজিদে এসি স্থাপন করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই কার্পেটিংয়ের মাধ্যমে মুসলিম ধর্মীয় এই উপাসনালয় পেয়েছে প্রশান্তির পরিবেশ। এছাড়া মন্দির স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগির মন্দির স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ রাস্তার প্রশস্তকরণ
বর্ষায় জলাবদ্ধতা নয়, আগের ভোগান্তিকে পেছনে ফেলে ক্যাম্পাসে এসেছে পরিচ্ছন্নতার ছাপ। তাছাড়া চলাচলের সুবিধা ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে বৃদ্ধি করা হচ্ছে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো। উপাচার্য জানান, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন না হওয়ায় ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতা হতো। এখন ক্যাম্পাসে ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। বৃষ্টি হলে আর জলাবদ্ধতা থাকে না।
ক্যাম্পাসে ৯ মাসে সংস্কার ও অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি সম্প্রতি ৯ মাস পার হলো। যখন দায়িত্ব নিই, তখন ক্যাম্পাসটি গোছানো ছিল না। তখন দেখি একাডেমি ভবন ছিল না। ছাত্রদের খেলার মাঠ ছিল না। সবকিছুতে সংস্কারের কাজে হাত দিতে হয়েছে। ক্যাম্পাসে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া দীর্ঘদিন বছর ধরে অবহেলায় থাকা নজরুল ভাস্কর্যের আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে।