‘চিৎকার করে বলছিলাম আমার পা ভেঙে গেছে মেরো না’
- সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১৪ PM , আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১৮ PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছিলেন বহু শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনতা। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো আন্দোলনে অংশ নেয় সোহরাওয়ার্দী কলেজের ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সোহেল। ১৮ জুলাই তারিখে হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহতও হন তিনি। তার সাথে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধির; জানিয়েছেন সে ভয়াবহ দিনে বর্ণনা।
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সোহেল বলেন, ১৮ জুলাই মিরপুর-১০ এ সকাল ১১টার দিকে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন মিরপুর-১০ চত্বরে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে আমার কলেজের বন্ধুরা মিরপুর-১১ তে অবস্থান নিয়েছে। তারা ফোন করে জোড়ালো ভাবে বললো মিরপুর-১১ তে যেতে। পথে আমি লক্ষ করি ছাত্র জনতার এক বিশাল দল মিরপুর-১০ এর দিকে যাচ্ছে। তখন আমি আবার আমার বন্ধুদের জানাই তারা যেন মিরপুর-১০ এ চলে আসে। ছাত্র জনতার এই বিশাল স্রোতের সামনে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিছুসময়ের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ থেকে মিরপুর-১০ কে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ছাত্রজনতা।
মিরপুর-২ এর দিকে অবস্থান করছিল পুলিশ বাহিনী। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বিশাল দল মিরপুর-২ থেকে ছাত্র জনতা তথা মিরপুর-১০ নম্বরের দিকে এগোচ্ছে। ছাত্ররা যখন এগিয়ে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে পুলিশি আগ্রাসনের মুখে পড়ে তারা। পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে একের পর এক টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। সেখানে এত পরিমাণ ছাত্রের উপস্থিতি ছিল যে পুলিশি কায়দায় ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করবার চেষ্টা করলেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল।
এভাবেই চলতে থাকে পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সেখান থেকে ছাত্র জনতাকে সরাতে পুলিশ আরও কঠোর হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি নিক্ষেপ শুরু করে। তখন ছাত্ররা পিছু হটতে বাধ্য হন। যখন পিছু হেঁটে মিরপুর-১১ এর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে ছাত্ররা তখন সেখানে আগে থেকেই ওত পেতে ছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তারা সেখানে ছাত্রদের উপর দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে থাকে। এদিকে হঠাৎ দুদিকের আক্রমণে ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন মাদার এন্ড চাইল্ড হসপিটালের গলিতে। অতিরিক্ত মানুষের কারণে অল্প কিছু সময়েই সে গলি পূর্ণ হয়ে যায় ,আমি দুর্ভাগ্যবশত পুরোপুরি সেই গলিতে ঢুকতে ব্যর্থ হই। সেই সুযোগে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সেই গলিতে হামলা করেন। ইট, পাটকেল নিক্ষেপও শুরু করেন কেউ কেউ। এসময়ে পেছনে ফিরে দেখি হেলমেট পরিহিত আমাদেরই মতন রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ ছাত্রদের উপর বাঁশ দিয়ে পায়ে আঘাত করেছেন। খানিকপরেই এক খণ্ড বড় ইটের টুকরো এসে লাগে আমার ঠোঁটে। ঠোঁট ফেটে শুরু হয় অঝোর ধারায় রক্তক্ষরণ। এর কিছুসময় পরেই একটি বড় ইটের টুকরো এসে লাগে আমার বাম পায়ে। তখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গলির ভেতরে মানুষের চাপ কমলে যখন সবাই বের হওয়ার চেষ্টা করছেন তখন আমি লক্ষ্য করলাম আমার পা ঝুলে গেছে। আমি সামনে এগোতে পারছি না, তার আগেই পড়ে যাচ্ছি। ছাত্ররা এগিয়ে যায় আমি একাই পড়ে থাকি।
আমাকে একা পেয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বাঁশ ও লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আমি চিৎকার করে বলছিলাম আমার পা ভেঙে গেছে আমাকে আর মেরো না। কিন্তু পা ভাঙার কথা শোনার পরেই সেই পায়েই আঘাত করছিল আর বলছিল, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আর কিছু বলবি? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আর কিছু বলবি? আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত আঘাত করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য ছাত্ররা এসে তাদের ধাওয়া দেয়। যখন তারা আমাকে ফেলে চলে যায়, আমি তখন ছাত্রদের বলি আমার পা ভেঙে গেছে আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাও। তখন কিছু ছাত্র আমাকে উদ্ধার করে আলোকের মাদার এন্ড চাইল্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের নেত্রীদের পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করার হুমকি রাবি প্রাধ্যক্ষের
তখন আমার জ্ঞান ছিল, দেখছিলাম আমার পুরো শরীর ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। আমি এক ছাত্র ভাইকে কাছে ডেকে বললাম, আমার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি বের করে আমার বন্ধুকে একটি কল দিতে। সে খানেক চেষ্টা করে জানালো আমার বন্ধু ফোন ধরছে না। বন্ধু ফোন ধরবেই বা কীভাবে? কারণ সেও তো ঘাড়ে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে আহত শুয়ে আছে আমার পাশের বেডেই। বন্ধুর এই অবস্থা দেখে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়লাম। একটু পর ডাক্তার এসে জানালেন তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। পাশের আজমল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
আজমল হাসপাতালে যাওয়ার পথে যাকে আমি মোবাইল ফোনটি দিয়েছিলাম তাকে এবং আমার মোবাইলটি হারিয়ে ফেলি। তখন বাধ্য হয়ে পরিবারকে জানাই। সে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ হওয়ার পূর্বেই আমার মা, আপু এবং দুলাভাই এসে উপস্থিত হন। চিকিৎসা শেষে আজমল হাসপাতালের দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক বললেন, আমাকে হাসপাতালে রাখা ঠিক হবে না। রাতে পুলিশের চেক হতে পারে।
তখন শুরু হয় আরেক পালিয়ে বাঁচার লড়াই। এরপর আমাকে নেওয়া হয় মিরপুর-১১ নম্বরের ডেলটা কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে আমার পা ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হল। ডাক্তার বললেন অন্তত তিন থেকে চারদিন ভর্তি থেকে অপারেশন করাতে হবে। সে হাসপাতালের প্রতিদিনের সিট ভাড়া ২৮০০ টাকা শুনে, বললাম আমার পরিবারের পক্ষে এখন এ খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তখন সে ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, বাসার চারদিন থাকার পরে অপারেশনের জন্য আসার। তার পরামর্শে বাসায় চলে গেলাম।
এরপরে শুরু হয় আরেক লড়াই, এবার সে লড়াইয়ের মুখোমুখি আমার পরিবার। এলাকার আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কানে আমার আহত হওয়ার ঘটনা পৌঁছালে তারা বিভিন্নভাবে আমার পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। খবর ছড়িয়ে পড়ে, আমাকে এই অবস্থায় পুলিশে ধরিয়ে দিবেন। আমার বাবাকেও বিচারের সম্মুখীন করা হবে। তারা কেন আমাকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেতে দিলো। এর ধারাবাহিকতায় ২৬ জুলাই আমার ছোট ভাইকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হল। যার বয়স হলো মাত্র ১৮ বছর। আম্মু পাগলের মতো ভাইকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ আম্মুর কাছে ভাইকে ছাড়ানোর জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করল। আম্মুর অনেক অনুরোধের পর পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা আমার ছোট ভাইকে ছাড়তে রাজি হল। ছাড়া পাওয়ার পরে আব্বু, ছোট ভাই ও দুলাভাই এলাকা থেকে দূরে আত্মগোপনে চলে গেল।
২৮ জুলাই ঢাকার এক বেসরকারি হাসপাতালে আমার অপারেশন হল। যেদিন অপারেশনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে হাসপাতাল আসছিলাম সেদিন আমাকে ধরে এম্বুলেন্সে তোলার মতনও কেউ ছিল না। আমার আম্মু ও আপুর গহনা বন্ধক করে এবং আত্মীয়স্বজনের থেকে ধার নিয়ে অপারেশনের টাকা জোগাড় করা হয়েছিল। ৩ আগস্ট আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরি। অনেকেই বলেন, ভাই অপারেশন কি সরকারি হাসপাতালে করানো যেত না?- সরকারি হাসপাতালে অপারেশন করাইনি কারণ সেসময়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে আহত বা আঘাতপ্রাপ্ত ছাত্রদেরকে খুঁজে খুঁজে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, সে ভয়ে।
৫ আগস্ট আমার দেশ দ্বিতীয় বারের মত স্বাধীন হয়েছে। যখন স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন হয়, সেদিনটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন। এতদিনে আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে। আমার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থাতে আছে অনেক ভাই এখনও। কারোর হাত নেই তো কারোর পা তবুও তাদের স্পিরিট আমাকে অনুপ্রাণিত করে। হয়ত আমার সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে কিন্তু একদিন ঠিকই আমি স্বাধীনতা ভোগ করবো। উপভোগ করতে পারবো আমার স্বাধীন দেশের স্বাধীন আকাশকে।
তিনি ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বর্তমানে তার পায়ে প্লাস্টার রয়েছে। আগামীকাল হাসপাতালে যাবেন প্লাস্টার খোলার জন্য। তার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি। এমনি ক্যাম্পাস থেকেও কোনো সহযোগিতা আসেনি। শুধু হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে কিছু শিক্ষক এসে খোঁজ নিয়ে গেছেন। এ মুহূর্তে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পড়ুয়া এ শিক্ষার্থী চান সকলের একটু মানবিক দৃষ্টি।