অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু নিয়ে মুখোমুখি ইউজিসি-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু নিয়ে ইউজিসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে
অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু নিয়ে ইউজিসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে  © লোগো

অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালু করা নিয়ে চিঠি প্রেরণ ও পাল্টা ‍উত্তর বিনিময় চলছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। নিয়ম বহির্ভুতভাবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দাবি করে দেওয়া ইউজিসির চিঠির উত্তর দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়ম মেনেই অন ক্যাম্পাস অনার্স চালু হচ্ছে বলে আইন উল্লেখ করে জবাব দিলেও আবারও চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। এতে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে বলে দাবি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন উল্লেক করে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ইউজিসির এক অফিস আদেশে কেন এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

ইউজিসি এ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ অনুযায়ী, দেশের ‘কলেজ শিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ ও উন্নতিসাধন, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ কলেজের যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ন্যস্ত করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়’ হওয়ায়  বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়। উক্ত আইনের ধারা-৬ অনুযায়ী ‘এই আইন এবং অর্ডার এর বিধান সাপেক্ষে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা নির্ধারিত।

ধারা-২(গ) অনুযায়ী ‘অর্ডার’ অর্থ ‘University Grants Commission of Bangladesh Order, 1973 (P. O. No. 10 of 1973)’ এবং আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান সংক্রান্ত ধারা-৮(১) অনুযায়ী ‘ডিগ্রি, ডিপ্লোমা এবং সার্টিফিকেট প্রদান সংক্রান্ত সকল স্বীকৃত শিক্ষাদান সাধারণতঃ কলেজ, স্কুল, এবং কেন্দ্র দ্বারা এককভাবে বা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত সহযোগিতায় অথবা এতদুদ্দেশ্যে একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রতিষ্ঠানের সহিত সহযোগিতায় পরিচালিত হইবে।’

আরও পড়ুনঃ কৃষি গুচ্ছের বিষয়প্রাপ্তদের নতুন তালিকা, জমা টাকা সমন্বয় যেভাবে

আইনে স্নাতকপূর্ব শিক্ষা বিষয়ক স্কুল সংক্রান্ত ধারা-২৮(১) অনুযায়ী ‘স্নাতকপূর্ব শিক্ষা বিষয়ক স্কুল একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেটের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কলেজের স্নাতকপূর্ব শিক্ষা সংগঠিত করিবে, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করিবে, একাডেমিক কাউন্সিলের বিবেচনার জন্য পরীক্ষা বিধি সুপারিশ করিবে, প্রশিক্ষণের মান সংরক্ষণ করিবে এবং শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করিবে’ বলে উল্লেখ আছে৷

তবে আইন মেনেই অন-ক্যাম্পাস অনার্স চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমানের। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ধারা ৩, ৬, ২৯, ৩১ ও ৪১ এর ১ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় অন ক্যাম্পাস স্নাতক কার্যক্রম চালাতে পারবে। আমরা এসব আইনের ধারা উল্লেখ করে ইউজিসির পাঠানো চিঠির জবাব পাঠিয়েছি। কিন্তু আইনের দিকে খেয়াল না করে আবারও পত্র দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছে ইউজিসি। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ধারা ৪১ এর ১ এ বলা হয়েছে, ‘এই আইন ও সংবিধির বিধান সাপেক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসমূহে স্নাতকপূর্ব, স্নাতকোত্তর ও অন্যান্য পাঠ্যক্রমে ছাত্র ভর্তি একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে নিযুক্ত ভর্তি কমিটি কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা পরিচালিত হইবে।’

এদিকে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করা একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অন-ক্যাম্পাস কার্যক্রম চালু করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পূর্ব শিক্ষা বিষয়ক স্কুলের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান উদ্বোধন করেছেন। 

একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যানের লক্ষ্য ১ এর ফলাফল ২ অনুযায়ী, কলেজ স্তরের শিক্ষার যথাযথ নিরীক্ষণের জন্য, পাঠ্যক্রম এবং অন্যান্য সাম্প্রতিক অগ্রগতির জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই প্রতিটি বিষয়ে নিয়মিত সীমিত সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে হবে। একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান অধিভুক্ত কলেজগুলিতে থাকা সকল সাধারণ বিষয়ে অবিলম্বে অন-ক্যাম্পাস স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করার পরামর্শ দেয়।

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করা একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অন-ক্যাম্পাস কার্যক্রম চালু করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পূর্ব শিক্ষা বিষয়ক স্কুলের ডিন অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান উদ্বোধন করেছেন। 

এর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের সংখ্যা ন্যায়সঙ্গত স্তর পর্যন্ত বাড়াতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী একাডেমিক ডিগ্রি প্রোগ্রামের সঙ্গে বর্তমান বা ভবিষ্যতের চাকরির বাজারের চাহিদা শর্ট কোর্স চালুর বিষয়ে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে।

পুনরায় কার্যক্রম চালু করার বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. নাসির উদ্দীন বলেন, ‍‘সেটি নীতি নির্ধারণী পর্যায় দেখবে। আমাদের কোন ভুল থাকলে সেটির দায় নিতে আমরা রাজী আছি।’ তিনি জানান, ১৪০ জনের ভর্তি নিয়ে ইউজিসির চিঠির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভর্তি কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। বিষয়টি সমাধান হয়ে গেলে ২য় মেরিট লিস্ট দিয়ে বাকি আসনগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। 

আরও পড়ুনঃ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রার ভবনে যেতে হবে না: অধ্যাপক সুপ্রিয়া

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা হয়ত প্রোগ্রাম চালিয়ে নেব। এখানে ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করা হচ্ছে না, শিক্ষার্থীদের জন্যই আমরা সবকিছু করছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০ কলেজের অনার্স কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্যও আমাদের নিজস্ব একটা মডেল থাকা উচিত। এসব কলেজের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে যা এপ্লাই করা যাবে।’ 

উপাচার্য  আরও বলেন, ‘ইউজিসি বলছে আইন পারমিট করে না। এ কার্যক্রম চালু করতে ইউজিসির পূর্বানুমতি লাগবে। অন-ক্যাম্পাসে আমরা এখানে কোন নতুন বিভাগ খুলছি না। আমাদের ৩৭টি পুরোনো বিভাগ রয়েছে, যেগুলোতে ইতিমধ্যে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি দিচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশে ৮০০ কলেজে এসব বিষয় পড়াচ্ছি। সেখান থেকেই মাত্র চারটি বিষয়ে স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। কলেজ নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি আমাদের মেইন ক্যাম্পাসেও কার্যক্রম চালানোর আইন ও সক্ষমতা রয়েছে।’

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অনুমতি না নিয়েই এ প্রোগ্রাম খুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সচিব ড. ফেরদৌস জামান। তিনি বলেন, এটি বিধিসম্মত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির চিঠির পাল্টা জবাব পাঠিয়েছে। কমিশনের মিটিংয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো আবু তাহের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আইন না মেনে এই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এছাড়া আইন বিভাগ চালু করতে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র নেয়া হয়নি।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আইনে ভর্তি নিতে বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র লাগবে না। ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহে আইন পড়ানো হচ্ছে। সেগুলো পরিচালনার জন্য আমাদের নিজস্ব একটি মডেল থাকা দরকার। 

জানতে চাইলে ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালকের কাছে খোঁজ নিতে বলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলমগীর। তবে কল দেওয়া হলে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমান। 


সর্বশেষ সংবাদ