প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আপত্তি’ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

দুই অর্থ বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা অডিট আপত্তি এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে আপত্তি রয়েছে, যা সরকারের পূর্বানুমোদন এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) কিংবা সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) প্রণয়ন ব্যতীত অনিয়মিতভাবে পূর্ত কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। 

১৬টি খাতের এই অডিট আপত্তি সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ৩৯৩ কোটি ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ২৭৫ টাকা। দেশের সর্বোচ্চ অডিট ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে এই অডিট আপত্তি দিয়েছে। অডিট অধিদপ্তরের দেয়া ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরে অডিট আপত্তি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।

আমরা প্রতিটা পয়সা হিসেব করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে খরচ করি। তারপরও যদি কোথাও মনে হয় অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে তাহলে তারা এসে ওপেন তদন্ত করুক। একেবারে প্রশাসনিক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এতে আমার কোন আপত্তি নাই-উপাচার্য

প্রতিবেদন আলোকে, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা প্রদান করায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি ৩ কোটি ২১ হাজার টাকা, বিভিন্ন কাজের ব্যয় নির্বাহের জন্য গৃহীত অগ্রিম সমন্বয় না করা অর্থ ৪২ কোটি ২৭ লাখ ৩ হাজার ৮৩০ টাকা, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত বই ভাতা প্রদান করায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি ৮৭ হাজার টাকা, পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের প্রদত্ত সম্মানী হতে আয়কর কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪৪ টাকা, অনিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্যতাহীন সম্মানি প্রদান করায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি ৭৪ লাখ ৪৫ হাজার ৮৮৪ টাকা এবং ২৫০০০ টাকার উর্ধ্বে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোটেশন আহবান প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে অনিয়মিতভাবে অর্থ ব্যয় ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার ৪৬ টাকা।

এছাড়া আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদকে চাঁদা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, অর্থ মন্ত্রনালয়ের পূর্বানুমোদন ব্যতীত অনিয়মিতভাবে গাড়ী ক্রয় ২৭ কোটি ৪৬ লাখ ২ হাজার ১০০ টাকা, ঠিকাদার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে চুক্তি না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারের দরপত্র জামানত বাতিল না করার বিবরণী ২ কোটি ১০ লাখ, বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ব্যতিরেকে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়, পূর্ত ও ভৌত কাজ বাবদ অর্থ ব্যয় ৩ কোটি ৩৭ লাখ ২৮ হাজার ৭২৮ টাকা।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই অর্থ বছরের ব্যয়ের উপর অডিট আপত্তি দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকভাবে এই আপত্তির জবাব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই বিষয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বিপাক্ষীয় মিটিং হয়ে আপত্তির বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে-পরিচালক, ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস বিভাগ

প্রকল্পের পূর্ত কাজের বিপরীতে ব্যয়িত টাকার ক্রয় সংক্রান্ত দলিলাদি এবং অগ্রগতির প্রতিবেদন নিরীক্ষায় উপস্থাপন করা হয়নি ৭ কোটি টাকা, পর্যাপ্ত কারিগরি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩টি আঞ্চলিক অফিস স্থাপন” প্রকল্পের পূর্তকাজ ডিপোজিট ওয়ার্ক হিসাবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে অর্পণ ৮০ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪০০ টাকা, ভ্যাট ও রাজস্ব টিকিট বাবদ অর্থ অনাদায় থাকায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ৫৪ লাখ ৯ হাজার ৭৪ টাকা।

মন্ত্রীপরিষদ কমিটির অনুমোদন এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতীত পূর্ত কাজের বিপরীতে চুক্তি সম্পাদন এবং অনিয়মিত ব্যয় ১০১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭৯০ টাকা, বিবিধ দেনাদার নামে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি ৩০ কোটি ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৫২১ টাকা, সরকারের পূর্বানুমোদন এবং ডিপিপি/আরডিপিপি প্রণয়ন ব্যতীত অনিয়মিতভাবে পূর্ত কাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন ১৬০ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৫৮ টাকা।

অডিট আপত্তির বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস বিভাগের পরিচালক মো. সাজেদুল হক বলেন, শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই অর্থ বছরের ব্যয়ের উপর অডিট আপত্তি দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকভাবে এই আপত্তির জবাব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা আরেকটি চিঠি পাঠিয়েছে। এই বিষয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বিপাক্ষীয় মিটিং হয়ে আপত্তির বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করি এরপর আর এই আপত্তি থাকবে না, এটি কেটে যাবে। 

এই আপত্তির কোন ভিত্তি নাই উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে তারা আপত্তি দিয়েছে এটার জন্যও নাকি আমাদের অনুমোদন নিতে হবে। এই মাস্টারপ্ল্যানে রয়েছে সিনেট ভবন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভবন এবং আইসিটি ভবন। এগুলোর ব্যাপারে বড়জোর আমরা সরকারকে অবহিত করতে পারি; কিন্ত এটার জন্য সরকারের কোন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে আমি এই আপত্তির কোন যৌক্তিকতা দেখিনা। এই আপত্তির মানে কি? এখানে তারা আমাদের কাজের গতি কমাতে চায় নাকি কাজটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আপত্তি দিয়েছে?  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোন নতুন ভবন অথবা হল করতে কি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন স্ট্রাকচারে বলা আছে এটি? এখানে তাদের জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল, ফিন্যান্স কমিটি, সিনেট কমিটি এবং সিন্ডিকেটসহ যেসব জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল সেসব জায়গায় গিয়েছে কিনা? ওইখানে ফাঁকি থাকলে অবশ্যই অন্যায় বলা যায়। আমার মাস্টারপ্ল্যান করতে এখানে সিন্ডিকেট সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।

তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পাসে মাস্টার প্ল্যানের অধীনে কিছু কাজের পাশাপাশি রংপুর, চট্টগ্রাম এবং বরিশালে আমাদের তিনটা আঞ্চলিক কেন্দ্রের কাজ চলছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনটার ৯০ ভাগ কাজ শেষ আবার কোনটা সম্পন্ন; কিন্তু বিভাগীয় আঞ্চলিক কেন্দ্রগলো তৈরিতে এখনো শুনেছি কমপক্ষে দেড় থেকে ২ বছর সময় লাগবে। এখন যে অনুমোদন নেয়ার কথা বলছে আমি যদি বলি কাজের গতি কমানোর কারণে আমার যে ভাড়া দিতে হয় এই অর্থ আমার লস যাচ্ছে। 

অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান

ড. মশিউর রহমান জানিয়েছেন, করোনা ক্রান্তিলগ্নের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে সরকারকে আমরা ১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি। এজন্য আমাদের ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। যেখানে টাকার অব্যাবস্থাপনায় সব ভেসে যায় সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্বচ্ছতা ধরে রেখে ২ হাজার কোটি টাকা জমিয়েছে এজন্য আমাকেসহ আমার সাবেক উপাচার্যদের অভিনন্দন জানানো দরকার। এই ইউনিভার্সিটিতে আমার আগের সবার দায়িত্ব নিব না; তবে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সাবেক দুই উপাচার্যসহ আমি যদি অর্থের স্বচ্ছ ব্যবহার না করতাম তাহলে এই অর্থ জমার কোন কারণ নেই। 

নিজেদের আর্থিক সকল হিসেব স্বচ্ছ দাবি করে উপাচার্য আরও বলেন, আমরা প্রতিটা পয়সা হিসেব করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে খরচ করি। তারপরও যদি কোথাও মনে হয় অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে তাহলে তারা এসে ওপেন তদন্ত করুক। একেবারে প্রশাসনিক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এতে আমার কোন আপত্তি নাই। এমনকি আমাদের এখানে কাজ করতে আসলে কোন কন্ট্রাক্টরও কাউকে চা খাওয়াতে হয় না। সেই জায়গায় যদি এত অডিট আপত্তি দেয় তাহলে তো কিছু বলার নাই। 

দুর্নীতিবাজদের খুঁজে বের করতে কোন বাইবেল-কোরআন পড়তে হয় না উল্লেখ করে ড. মশিউর রহমান আরো বলেন, আমি নিজেই সাংবাদিকদেরসহ বিভিন্ন জায়গায় বলেছি যে, শুধুমাত্র চিহ্নিত ৫ হাজার লোকের ব্যাংক একাউন্ট আর ১০ বছরের পরিবর্তন দেখলেই দুর্নীতিবাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়; এদেশে কয়টা লোক চোর এটা সবাই জানে। ধানমণ্ডিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বাসা নিয়েছে আমাদের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ। ওই বাসার আগের মালিক বলেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কোটি টাকার জিনিস লেনদেন হয়েছে কিন্তু আমি কোন দিন উপাচার্য স্যারের চেহারা পর্যন্ত দেখি নাই। সেই হারুন স্যারকে দুদকে দৌঁড়াতে হচ্ছে। আমাদের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ স্যার সম্পর্কে অফিস স্টাফরা বলে তিনি চা খাইতেন তার নিজের টাকায়। তাকে পর্যন্ত কালিয়াকৈর কোর্টে হাজির হতে হয়েছে ৮ থেকে ৯ বছর। 

এ বিষয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমিমুল এহসান কবিরের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence