ভোট দিলেও গণনা হবে না—বাংলাদেশের নির্বাচনে টেন্ডার্ড ভোট কী?
- বিবিসি বাংলা
- প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫২ AM
ভোট দিতে গিয়ে অনেক সময় ভোটারদের শুনতে হয়—‘আপনার ভোট হয়ে গেছে’। নিজের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়ার এমন ঘটনা বাংলাদেশের ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়মিত ঘটছে। ভোট দিতে না পেরে হতাশ হয়ে কেন্দ্র ছাড়তে হয় বহু ভোটারকে। এ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা, উত্তেজনা এমনকি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে ভোট দেওয়া হয়ে গেছে জানানো হলেও আইনি প্রতিকার যে রয়েছে, তা অনেক ভোটারই জানেন না। নির্বাচন কমিশনের ভাষায় একে বলা হয় ‘টেন্ডার্ড ভোট’, যা সাধারণভাবে পরিচিত ‘সান্ত্বনা ভোট’ হিসেবে।
নির্বাচনী আইনে টেন্ডার্ড ভোটের বিধান থাকলেও এটি প্রাথমিকভাবে গণনায় ধরা হয় না। কেবল আদালতের নির্দেশে এই ভোট গণনা করা হতে পারে। প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ায় সাধারণ ভোটাররা আদালতের দ্বারস্থ হন না বলেই নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ এই ভোট ব্যবস্থাকে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের ‘প্রতারণা’ বলে অভিহিত করছেন।
ভোটারদের ‘সান্ত্বনা’ দিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও টেন্ডার্ড ভোটের ব্যবস্থা থাকছে। নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সংশোধিত আরপিওতে টেন্ডার্ড ভোটিং বা ‘সান্ত্বনা ভোট’ ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশোধনীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও জবাবদিহিমূলক করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
টেন্ডার্ড ভোট প্রসঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটাররা প্রতারণার শিকার হন। কিন্তু কমিশন যদি তৎপর না হয় এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন পুরোপুরি শুদ্ধ ও নিরপেক্ষ করতে এসব ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। নির্বাচন যেন অন্তত গ্রহণযোগ্য হয়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। টেন্ডার্ড ভোট আগেও ছিল, তাই এটি পরিবর্তন করা হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যদি জানতে পারেন তার ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভোটার স্লিপ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে অথবা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারলে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার ভোট গ্রহণে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার নিজের সই করা কাগজে ভোটারের সিল গ্রহণ করে তা সংরক্ষণ করেন। এই ভোট ব্যালট বাক্সে ফেলা হয় না এবং সাধারণ গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটাই টেন্ডার্ড ভোট, যা মূলত ভোটারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রাখা হয়।
আরও পড়ুন: বিএনপির টার্গেট কমপক্ষে ৫০ লাখ
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, কোনো ভোটার যদি দেখেন তার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে এবং তিনি ভোট দেননি তা প্রমাণ করতে পারলে যে ভোট দেওয়া হয়, সেটিই টেন্ডার্ড ভোট। তবে এই ভোট ব্যালট বাক্সে রাখা হয় না এবং গণনায় আসে না। এ কারণেই একে একদিকে ‘সান্ত্বনামূলক’, অন্যদিকে ‘প্রতারণামূলক’ ভোট বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর ৩২(১) অনুচ্ছেদে টেন্ডার্ড ভোটের বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ব্যালট পেপারের জন্য আবেদন করে জানতে পারেন যে তার নামে অন্য কেউ আগেই ভোট প্রদান করেছে, তাহলে তিনি একটি ‘টেন্ডার্ড ব্যালট পেপার’ পাওয়ার অধিকারী হবেন। ভোট দেওয়ার পর সেই ব্যালট প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে জমা দিতে হবে। প্রিসাইডিং অফিসার ব্যালটটি আলাদা খামে রেখে ভোটারের নাম ও নম্বর লিখে সংরক্ষণ করবেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা জানান, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও টেন্ডার্ড ভোটের বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ভোটার উত্তেজিত হয়ে পড়া বা বিশৃঙ্খলা এড়াতে এই ভোট ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল ভোটারকে সান্ত্বনা দেওয়া।
তবে নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, টেন্ডার্ড ভোট সম্পর্কে প্রচারণার অভাবে অধিকাংশ ভোটারই জানেন না যে তাদের ভোট গণনায় আসছে কি না। আব্দুল আলীম বলেন, ভোট নেওয়া হলেও গণনা না হওয়ায় এটি ভোটারের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। ভোটার বুঝতেই পারেন না তার ভোটের কী হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, টেন্ডার্ড ভোট গণনায় ধরলে বড় ধরনের সংকটও তৈরি হতে পারে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের ১৯৭টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল। জেসমিন টুলীর মতে, যদি শতভাগ ভোটের কেন্দ্রে টেন্ডার্ড ভোটও গণনায় আনা হয়, তাহলে ভোটের হার ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণেই এই ভোট গণনায় আনা হয় না।
তবে কোনো নির্বাচনে দুই প্রার্থীর ভোট সমান হলে আদালতের নির্দেশে টেন্ডার্ড ভোট গণনার সুযোগ রয়েছে বলেও জানান বিশ্লেষকরা।
টেন্ডার্ড ভোটের পাশাপাশি আরেক ধরনের ভোট রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘আপত্তিকৃত ভোট’। কোনো প্রার্থী বা তার পোলিং এজেন্ট যদি কোনো ভোটারকে চ্যালেঞ্জ করেন যে তিনি আগেই ভোট দিয়েছেন, তখন ভোটার আপত্তি তুলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভোটার ১০০ টাকা মুচলেকা দিয়ে ব্যালট নিয়ে ভোট দিতে পারেন। এই ভোটকে বলা হয় আপত্তিকৃত ভোট।
আরপিও অনুযায়ী, আপত্তিকৃত ভোটের ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটারের নাম-ঠিকানা আলাদা তালিকায় লিপিবদ্ধ করেন এবং ব্যালট পেপারে ভোটারের স্বাক্ষর বা টিপসই গ্রহণ করেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আপত্তিকৃত ভোট গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে। গণনা শেষে এসব ব্যালট আলাদা খামে সংরক্ষণ করা হয়।
টেন্ডার্ড ভোট ও আপত্তিকৃত ভোটের মূল পার্থক্য হলো—টেন্ডার্ড ভোট সাধারণত গণনা করা হয় না এবং এতে কোনো মুচলেকা দিতে হয় না, আর আপত্তিকৃত ভোট গণনা করা হয় এবং ভোটারকে মুচলেকা দিয়ে ভোট দিতে হয়।