জুলাই ঘোষণা ছাড়া নিষ্কৃতি নেই: রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি শিশির মনিরের খোলা চিঠি

মোহাম্মদ শিশির মনির
মোহাম্মদ শিশির মনির  © সংগৃহীত ছবি

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন সংবিধান ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রোববার (১৩ জুলাই) তিনি এই চিঠিতে সাহসী সংস্কার, নতুন সংবিধান বন্দোবস্ত এবং “জুলাই ঘোষণা”র মতো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

অ্যাডভোকেট শিশির মনিরের চিঠিটি  হুবহু তুলে ধরা হলো- কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! কী সেই ভুল? কে করছে? কেন হচ্ছে? না বুঝে? নাকি বুঝেও ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে? এর ফলাফল কী? ভেবে দেখেছেন? পরামর্শ নিয়েছেন? যদি নিয়ে থাকেন কার পরামর্শ? কী বিষয়ে পরামর্শ? কেন পরামর্শ দরকার? বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয়েছে? তারা কী উপদেশ দিয়েছেন? পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক করেছেন? অতীতের নজিরগুলি ঘাটাঘাটি করেছেন? নাকি শুধু হৈ-হুল্লোড়ই করছেন? শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত আছেন।

এতগুলো প্রশ্ন করলাম বিষয় তো বলিনি। বিষয়টি সংবেদনশীল। প্রতিনিয়তই আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু সমাধান বের হচ্ছেনা। সাহস করে আপনারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। অজানা ভয় আর আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিত্যদিনের সঙ্গী। আমার উস্তাদ বলতেন যে জিনিস মাথায় ধরেনা, তা আসলেই ষড়যন্ত্র। মাথায় যদি ধরতো তাহলে জট খুলে যেত। তখন আর ষড়যন্ত্র মনে হতো না। সেটি হলো- জুলাই ঘোষণা; জুলাই সনদ; গণভোট। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। ভেবে দেখুন, বিগত প্রায় এক বছরে কতবার এই শব্দগুলো উচ্চারণ করা হয়েছে। বক্তব্যে, আলোচনায়, জনসমাবেশে, সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে, সংস্কারে ঘুরেফিরে এগুলোই আলোচ্য বিষয়। কিন্তু কী পদ্ধতিতে সমাধান হবে? তাতো বের হলো না। কী পদক্ষেপ হবে? কখন হবে? কীভাবে হবে? কারা পদক্ষেপ নিবে? এগুলোই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। চলুন একটু দেখে নেই।

এবার আসি আসল কথায়। গুরুত্বপূর্ণ কথা। জাতির ভবিষ্যতের কথা। সাংবিধানিক কথা। সমাধানের কথা। সেটি হলো-ক) জুলাই ঘোষণা; গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। একটি সরকার বিদায় নিয়েছে। আরেকটি সরকার গঠিত করেছে। সেনাবাহিনী পাশে আছে। বিদেশিরা সাহায্য করছে। ঐকমত্যের প্রচেষ্টা চলছে। বিচারকাজ এগিয়ে চলছে। সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়া হয়নি। উদ্যোগ নিয়েও থমকে গেছে। সন্দেহ কাজ করছে। কিছুটা সাহসের অভাব লক্ষণীয়।

কী থাকবে এখানে? কী থাকা জরুরি? না থাকলে কী হবে? এই বিতর্ক আর কতদিন চলবে? কেনইবা চালাবেন? জুলাই ঘোষণাপত্রই পারে স্পষ্ট সমাধান বের করতে। এর বাইরে গিয়ে অন্যকিছু গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারবে না। সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা থেকে যাবে।

অনেকেই বলেন বাচ্চারা কী বুঝে? আমরা অভিজ্ঞ লোক। কতকিছু দেখলাম? তাদের কী অভিজ্ঞতা আছে? আন্দোলন করা আর সরকার চালানো এক জিনিস নয়। আমরা ঠিক করবো কী করতে হবে। দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি আমরা। তারা তো সাময়িক সময়ের জন্য এসেছিল। তাদের কাজ শেষ। এইবার পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে হবে। এটাই স্থায়ী সমাধান।

জুলাই ঘোষণা ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন কেমনে? শুধু বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে? আর এটা ঘোষণা করতে এত ইগো কীসের? কেন নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পারেন না? এটা কী মানসিক ব্যাপার? নাকি বুঝতেছেন না? যাই করেন জুলাই ঘোষণা ছাড়া নিষ্কৃতি পাবেন না। আপাতত মনে হচ্ছে একটু ভালো অবস্থায় আছেন। সময় ফুরালেই কিন্তু পুরোনো কাঁসুন্দি বের হয়ে আসবে। তখন সামলাতে পারবেন না। তাই তাড়াতাড়ি একসাথে বসেন। ঘোষণা তৈরি করেন। সরকারিভাবে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাপত্রকে আইনি মর্যাদা দিন। সাহস দেখাতে পারলে বর্তমান সংবিধান স্থগিত করে দেন। এটাই পথ। একমাত্র পথ। ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলতে পারবেন না। সমাধান কিন্তু বের করতে পারবেন না। বাচ্চারা বের করেছে সমাধান। তাদের কথা মেনে নেন। বাচ্চাদেরকে অবহেলা কইরেন না। অনেক সময় সন্তানের কথা মেনে নিতে হয়। আধুনিক যুগ। বয়স কম হলেও তারা অনেক কিছু জানে। তারুণ্যের জোয়ার তো আছেই। এটা বাধা মানেনা। পাহাড় ডিঙ্গাতে চায়। মরুভূমিতে সবুজ ঘাসের চাষ করতে চায়। অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়। ইতোমধ্যে করেও ফেলেছে। তাহলে তাদেরকে বাচ্চা বলবো কেমনে! বরং তারাই আমাদের সুযোগ্য সন্তান। অভিভাবকদের নিরাপদে রাখার জন্য এই বয়সেই দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে৷ ঘানি টেনে বেড়াচ্ছে। সংসারে এরকম সন্তানের খুব দরকার। 

জুলাই সনদ

ধরুন সংবিধান স্থগিত করলেন তাহলে দেশ চলবে কীভাবে? সংস্কার হবে কী করে? কারা করবে সংস্কার? ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ভবিষ্যৎ কী? শুধু আলোচনাই সীমাবদ্ধ নাকি কোন আইনগত মর্যাদা পাবে? ধরুন, কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলো। তারপর জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলো। তাহলে এই নির্বাচনে কী দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে? নাকি এককক্ষই থেকে যাবে? প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য হবে? বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পীকার হবে? দশ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না এই বিধান হবে? দলীয় প্রধান এবং সরকার প্রধান ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি হবেন? পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় হবে? স্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক হবে? নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে? যদি এই নির্বাচন নতুন নিয়মে না হয়, তাহলে এত আলোচনার অর্থ কী? শোনা যাচ্ছে, কেউ কেউ বলছেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংবিধান সংশোধন করবে। আর আগামী নির্বাচন পূর্বের নিয়মেই হবে। অর্থাৎ নতুন নিয়ম কার্যকর হতে আরও ৫ বছর সময় লাগবে। নতুন সংসদ এসে যদি সংশোধন না করে বেমালুম ভুলে যায় তখন কী হবে? কে তাদের বাধ্য করবে? তখন গণঅভ্যুত্থানের চেতনার কী হবে? শহিদ, আহত, পঙ্গু ভাই-বোনদের কী জবাব দিবেন? এই জমাটবাঁধা রক্ত আর লাশের গন্ধ কী তাড়া করে বেড়াবে না? গভীর ঘুমে স্বপ্নে এসে তারা আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবেনা? নাকি আলোচনা এখানেই শেষ?

সহজভাবে ভেবে দেখুন। জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়া হলো। বর্তমান সংবিধান স্থগিত হলো। জুলাই সনদ ঘোষণা হলো। এই সনদের অধীন নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো। তারপর গঠিত সংসদ এই সনদ অনুমোদন করলো। বাংলাদেশ নতুন যাত্রা শুরু করলো। এই পদ্ধতি মানতে সমস্যা কোথায়? এটা তো স্পষ্ট পদ্ধতি। সকলে মিলে ঐকমত্য কমিশনকে গিয়ে বলেন যে আমরা এই পদ্ধতি চাই। দেখবেন দ্রুত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। জুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ, সংস্কার, নির্বাচন সব প্রক্রিয়া আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু ইগো দেখালে বা গো-ধরলে সমাধান তো হবেনা। বড়-ছোটর হিসেব করতে করতেই টাইম শেষ। তখন প্রশ্ন আসবে কার কারণে এরকম হচ্ছে? বিএনপি? জামায়াত? এনসিপি? ইসলামী আন্দোলন? হেফাজত? গণঅধিকার পরিষদ? সিপিবি? বাসদ? জাসদ? গণসংহতি আন্দোলন? খেলাফত মজলিশ? নেজামে ইসলাম? কে? কে?

যার কারণে বাধাগ্রস্ত হোক না কেন সময় কিন্তু বহমান। কে কি ভূমিকা রাখছে? সময়ই উত্তম স্বাক্ষী। কার ভূমিকা পজিটিভ আর কার ভূমিকা নেগেটিভ তা স্পষ্ট হবেই। আমরা করবো? নাকি আমি করবো? এই বিতর্ক দৃশ্যমান। নতুন প্রজন্ম এই বিতর্ক শুনতে চায়না। সোজাসুজি সমাধান চায়। যদি সকলের সেন্টিমেন্ট ধারণ করতে চান, তাহলে প্রো-একটিভ ভূমিকা রাখুন। রিয়েকটিভ ভূমিকায় আস্থা অর্জন করতে পারবেন না। যতো লুকোচুরিই করিনা কেন শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই লুকানো থাকেনা, থাকবেনা। প্রকাশিত হবেই।

তাই বলি, পিছনে টেনে ধরা সঠিক নয়। সম্মুখে অগ্রসর হতে দিন। দ্রুত জুলাই ঘোষণা প্রদান করার আল্টিমেটাম দিন। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ করুন। প্রস্তাব গুলো হয় মেনে নিন না হয় আরও উন্নত প্রস্তাব দিন। আত্ম-অহমিকা ত্যাগ করুন। জুলাই সনদ স্বাক্ষর করুন। নতুন বন্দোবস্তে নির্বাচন করুন। পাশ-ফেল মেনে নিন। নতুন সংসদ গঠিত হোক। গঠনমূলক ভূমিকা রাখুন। জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবেই জাতীয় নেতার মর্যাদা পাবেন। 


সর্বশেষ সংবাদ