প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী

মমতা ব্যানার্জি
মমতা ব্যানার্জি  © সংগৃহিত

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো আজ বুধবার (৫ মে) শপথ নিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যটির রাজনীতিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় নেতা তিনি। তবে মমতার আজকের অবস্থানে আসাটা তার জন্য এতোটা সহজ ছিল না। বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাকে এতোদূর আসতে হয়েছে।

বড় পরিবারের ভরণপোষণ সামলাতে একসময় স্টেনোগ্রাফারের কাজ করেছেন মমতা। শিক্ষকতা করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাইভেট টিউটর এমনকি সেলসগার্লের কাজও করেছেন। এর মধ্যেই ইতিহাসে স্নাতক ও ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ডিগ্রি নিয়েছেন আইন ও শিক্ষকতা পেশার ওপরও। পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন। হয়ে উঠেছেন চিত্রকরও। আবার এত কিছুর মধ্যেও রাজনীতির বন্ধুর পথ ছেড়ে আসেননি। ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনের কঠোর এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মমতা ব্যানার্জি হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। গোটা রাজ্যের জনসাধারণের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘দিদি’ হিসেবে।

আরো পড়ুন তৃতীয়বারের মতো বাংলার মাটিতে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নেবেন মমতা

ব্যক্তিজীবনে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। এ সংগ্রামমুখর জীবনের মধ্যেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১৫ বছর বয়স থেকে। পিতা-মাতা ছিলেন কংগ্রেসের কট্টর সমর্থক। সে জায়গা থেকেই যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেসের ছাত্র উইংয়ে। ওই সময় তার পিতা প্রমিলেশ্বর ব্যানার্জির মৃত্যু হয় অনেকটা বিনা চিকিৎসায়। পিতার অকালমৃত্যুতে পরিবারও নিপতিত হয় চরম দারিদ্র্যে। বিধবা মা ও আট ভাইবোনের সংসারে চরম অভাবের মধ্যেও নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন মমতা।

বলা হয়, দক্ষিণ কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে মমতা পশ্চিম বাংলার মানুষের সংস্কৃতিকে বেশ ভালোই বোঝেন। এ কারণে তার রাজনীতিও আবর্তিত হয় সে সংস্কৃতিকে ঘিরেই। সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনেও তার স্লোগান ছিল- ‘বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়’। এছাড়া নিজ দলের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তার ভিত্তি অনেক শক্ত। মূলত এ দুয়ের ওপর ভিত্তি করেই এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনেক বড় বড় চমক দেখিয়েছেন তিনি।

ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ভারতের রাজ্যভিত্তিক রাজনীতিতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীদের অন্যতম মমতা ব্যানার্জি। কারো ছত্রচ্ছায়া বা পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, মমতা ব্যানার্জি নিজের যোগ্যতায়ই এত দূর আসতে পেরেছেন। জীবনের শুরুর দিককার দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে তিনিও নিজেকে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে। এজন্য তার মধ্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বেশ সহমর্মিতাও দেখা যায়। অন্যদিকে তার জীবনযাপনও পুরোপুরি আড়ম্বরবিহীন।

আরো পড়ুন নন্দীগ্রামে হারলেও যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন মমতা

২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হওয়ার পর গোটা ভারতেই রীতিমতো গেরুয়া ঝড় ওঠে। তবে এ পর্যন্ত শুধু মমতা ব্যানার্জিই সে ঝড়কে সফলভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছেন। একসময় কংগ্রেস থেকে প্রায় বিতাড়িত মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন। ২০১১ সালে তার নেতৃত্বেই পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের সফল অবসান ঘটাতে সক্ষম হয় তৃণমূল কংগ্রেস।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়লাভ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাজ্য সরকার গঠন করতে যাচ্ছে দলটি। রাজ্যের প্রায় অর্ধেক ভোটার এবার তৃণমূলেই ভোট দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বগুণ ও ক্যারিশমাতেই পশ্চিমবঙ্গে এবারো বড় বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছে তৃণমূল।

১৯৯০ সালের দিক থেকে কংগ্রেসের রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান হয়েছিল মমতার। ওই সময় তিনি হয়ে ওঠেন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় নেতা। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসার পর ওই সময়কার ব্যাপক জনভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে শুধু রাজনীতিতে টিকে থাকেননি। একই সঙ্গে রাজনীতির ময়দানও গরম করে ফেলেছেন দ্রুত দল গুছিয়ে।

বরাবরই তার প্রধান জনভিত্তি ছিল কলকাতা ও আশপাশের জেলাগুলোর কর্মজীবী নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে। এছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেসের সমর্থক মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোরও ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস ছাড়েন ১৯৯৭ সালে। সে সময় এসব শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত পরিবার তার পাশে এসে দাঁড়ায়। পাশে অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা পায় তৃণমূল কংগ্রেস। মমতার জনভিত্তির জোর টের পাওয়া যায় এর দুদিন পর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি। ওইদিন কলকাতার শ্যামবাজারে পাঁচ মাথার মোড়ে তৃণমূলের প্রথম জনসমাবেশ ডাকেন মমতা ব্যানার্জি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বৃহৎ একটি অংশ ছুটে আসে ‘দিদির’ সমর্থনে।

আরো পড়ুন নন্দীগ্রামের ফল নিয়ে নাটকীয়তা: মমতা নয়, জিতেছেন শুভেন্দু

২০১১ সালে মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতার অবসান ঘটাতে সমর্থ হয় তৃণমূল। এর আগ পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে কলকাতায় ক্ষমতার পালাবদলের প্রয়াস চালিয়ে গিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি।

ঘনিষ্ঠদের ভাষ্যমতে, অত্যন্ত কঠিন সে প্রয়াস চালাতে গিয়ে কখনো কখনো হতাশও হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে ২০০১ ও ২০০৬ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ও ২০০৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। আবার সে হতাশা কাটিয়ে দ্রুত ফিরেও এসেছেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি নিয়ে সবসময়ই বেশ সচেতনতা দেখিয়ে এসেছেন মমতা ব্যানার্জি। বরাবরই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন এখানকার ইতিহাস, ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রতি। প্রথমবার নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক নতুন সংস্কৃতি চালু করেছেন মমতা ব্যানার্জি। আধুনিক ইতিহাসের প্রত্যেক প্রথিতযশা বাঙালির জন্মদিন মনে রাখেন তিনি। তাদের মধ্যে যেমন অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা বা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন পুরনো আমলের চলচ্চিত্র অভিনেতাও। এ প্রথিতযশা বাঙালিদের জন্মদিনে তাদের প্রত্যেকের ছবিতে ফুল দিয়ে রাইটার্সে অফিস শুরু করেন মমতা। বাংলা কবিতা, চিত্রকলা ও সংগীতের প্রতিও ব্যাপক অনুরাগ দেখিয়ে এসেছেন তিনি।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে, দলটির প্রতীক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ দেখিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক হলো ঘাসের মধ্য দিয়ে গজিয়ে ওঠা একটি বৃন্তে দুটি ফুল। এ প্রতীকের মূল অনুপ্রেরণা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার লাইন- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান’।

আরো পড়ুন পশ্চিমবঙ্গ জয়ের হ্যাটট্রিকের পথে মমতা

মমতা ব্যানার্জির এ সংস্কৃতিমনা আবহ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। অন্যদিকে তার সাদাসিধে জীবনযাপন নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে তার জনভিত্তিকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, ভারতের রাজ্যভিত্তিক রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী নারী ধরা হয় তিনজনকে। তারা হলেন উত্তর প্রদেশের মায়াবতী, তামিলনাড়ুর জয়ললিতা ও পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি। তাদের মধ্যে মায়াবতী ও জয়ললিতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল দুজন শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি উঠে এসেছেন সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে। এমনকি এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে রাখার মতো বিশেষ কোনো পরিচয়ও ছিল না তার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট; এখানে তৃণমূল ও মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়লাভ অনেক কঠিন। ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মমতা উঠে এসেছেন একেবারে তৃণমূল থেকে। এ কারণে তৃণমূলে কাজ করা নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার বোঝাপড়াও অনেক বেশি। তাদের আনুগত্যও প্রশ্নাতীত। ২৩ বছর আগে যখন তিনি কংগ্রেস ছেড়ে আসেন, তখনো তার আশপাশে কংগ্রেসের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই এসে ভিড় করেছিলেন। দলটির নামকরণ ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ করা মূলত তাদের সম্মানেই।


সর্বশেষ সংবাদ