নোবেল শান্তি পুরস্কার: ট্রাম্পের মনোনয়ন ও পুরস্কার ঘিরে বিতর্কের ইতিহাস
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪০ AM , আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫, ০১:৪৯ PM
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম মনোনয়ন দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। জনশ্রুতি অনুযায়ী, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ট্রাম্পের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা।
সম্প্রতি এক বৈঠকে নোবেল কমিটিকে পাঠানো চিঠির একটি কপি ট্রাম্পকে উপহার দেন নেতানিয়াহু। সেসময় তিনি বলেন, ‘তিনি (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প) একের পর এক দেশে, একের পর এক অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছেন।’
শুধু ইসরায়েল নয়, পাকিস্তানও গত জুনে ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার পক্ষে মত দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, এর আগে মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছিলেন ট্রাম্প। তবে ঠিক তার পরপরই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।
বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত নোবেল শান্তি পুরস্কার, সুইডিশ বিজ্ঞানী ও সমাজসেবী আলফ্রেড নোবেলের নামে প্রবর্তিত ছয়টি পুরস্কারের মধ্যে একটি। প্রতি বছর নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি এই পুরস্কার দিয়ে থাকে।
যদিও এর উদ্দেশ্য মহৎ, তবুও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যাযোগ্য মতবিরোধের কারণে শান্তি পুরস্কার প্রায়ই বিতর্কের মুখে পড়ে। নিচে এমন কিছু বিতর্কিত পুরস্কারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো—
বারাক ওবামা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ৯ মাসের মাথায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নিজেই বিস্মিত হয়ে স্মৃতিকথায় লেখেন, পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনে তার মনে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল, “কীসের জন্য?”
উল্লেখযোগ্যভাবে, ওবামার শপথ গ্রহণের ১২ দিন পরই মনোনয়ন জমার শেষ তারিখ ছিল। যদিও পুরস্কারের পেছনে যুক্তি ছিল ভবিষ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা, বাস্তবে তার শাসনামলে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ২০১৫ সালে নোবেল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক গেইর লুন্ডেস্টাড জানান, এই সিদ্ধান্তে পরবর্তীতে কমিটির অনুশোচনা ছিল।
ইয়াসির আরাফাত
ওসলো শান্তি চুক্তির জন্য ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেসকে যৌথভাবে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে আরাফাতের অতীতের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতিহাস বিতর্কের জন্ম দেয়। এমনকি নোবেল কমিটির অভ্যন্তরেও এ নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। এর প্রতিবাদে নরওয়েজিয়ান রাজনীতিবিদ ও কমিটির সদস্য কারে ক্রিস্টিয়ানসেন পদত্যাগ করেন।
হেনরি কিসিঞ্জার
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য শান্তিতে নোবেল পান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দক্ষিণ আমেরিকার স্বৈরশাসকদের সমর্থন এবং কম্বোডিয়ায় গোপন বোমা হামলার অভিযোগ ছিল। পুরস্কার ঘোষণার প্রতিবাদে নোবেল কমিটির দুই সদস্য পদত্যাগ করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তখন ব্যঙ্গ করে একে “নোবেল ওয়ার প্রাইজ” বলে মন্তব্য করে।
অং সান সু চি
মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন অং সান সু চি। কিন্তু ক্ষমতায় এসে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরব ভূমিকার কারণে তার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হয়। অনেকে তার নোবেল বাতিলের দাবি তুললেও পুরস্কার প্রদান নিয়ম অনুযায়ী তা সম্ভব নয়।
আবি আহমেদ
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মেটানোর জন্য শান্তি পুরস্কার পান। কিন্তু এর এক বছরের মাথায় টাইগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করেন, যা রূপ নেয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে। এই যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারান ও লক্ষ লক্ষ মানুষ মানবিক সংকটে পড়েন। ফলে আবির নোবেল প্রাপ্তি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়।
ওয়াঙ্গারি মাথাই
প্রথম আফ্রিকান নারী হিসেবে শান্তি পুরস্কার পান কেনিয়ার পরিবেশবাদী ও জীববিজ্ঞানী ওয়াঙ্গারি মাথাই। তার গঠিত গ্রীন বেল্ট আন্দোলনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগানো হয়। তবে পরবর্তীতে তার দেওয়া একটি মন্তব্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তিনি দাবি করেন, এইচআইভি ভাইরাসকে জৈব অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের ধ্বংস করতে। তার এই বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
নোবেল না পাওয়া উল্লেখযোগ্য নাম: মহাত্মা গান্ধী
নোবেল শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাদ পড়া নাম হলো মহাত্মা গান্ধী। অহিংস আন্দোলনের এই ভারতীয় পথিকৃৎ পাঁচবার মনোনয়ন পেলেও কখনোই পুরস্কার পাননি। ২০০৬ সালে নোবেল কমিটির তৎকালীন প্রধান গেয়ার লুন্ডেস্টাড জানান, গান্ধীর প্রাপ্য স্বীকৃতি না দেওয়াটাই শান্তি পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে যান, তাহলে তিনি হবেন সেই সব নেতাদের একজন, যাদের পুরস্কার পাওয়া ঘিরে বিতর্ক কখনো থামেনি। তবে ইতিহাস বলছে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বরাবরই রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি।