ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে মুহাম্মদ আলী: হেরে গিয়েও জয়ী যিনি
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০৬ AM , আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১৩ PM
ক্রীড়াজীবনের শুরু থেকেই রিংয়ের ভেতরে ও বাইরে অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণের পর আলী আমেরিকান মুসলিমদের জন্য আদর্শে পরিণত হন। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মুষ্টিযোদ্ধা
মুহাম্মদ আলী। জন্ম নাম ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র। একজন মার্কিন পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, সাধারণভাবে যাকে ক্রীড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেভিওয়েট হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাঁকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় ও বিবিসি তাঁকে শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত করেছে।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে, আলী তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের বিরোধিতার কারণে মার্কিন সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান করতে অস্বীকৃত হন। এর কয়েকদিন পরে তাঁকে এই কারণে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর বক্সিং উপাধি কেরে নেওয়া হয়। তিনি তাঁর জীবনের সেরা সময়ে পরবর্তী চার বছর কোন ধরণের বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আপীল সুপ্রিম কোর্টে পেশ হয়, যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সরিয়ে নেওয়া হয়।
২০১৮ সালে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের নামে সম্পর্কিত অনেকের নামের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। আমি মুহাম্মদ আলীকে নিয়ে ভাবছি। আমি তাঁকে এবং অন্যদের বেশ গুরুত্ব দিচ্ছি। এমন কিছু ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল, যেটা ন্যায্য ছিল না। যদিও এর পর পরই মোহাম্মদ আলীর আইনজীবী রন টুইল একটি বিবৃতিতে বলেন, ক্ষমার আর প্রয়োজন নেই। যেহেতু সুপ্রিমকোর্ট মোহাম্মদ আলীর দণ্ড অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে, সেখানে দণ্ড না থাকলে এ রকম ক্ষমার আর প্রয়োজন থাকে না।
কেন ইসলাম গ্রহণ করেন আলী
১৯৬৪ সালে ধর্মান্তরিত হওয়ার কয়েক বছর পরই মুহাম্মদ আলী এমন একটি লড়াইয়ে অংশ নেন, যা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত জীবনের কিছু স্মৃতি লিখে রাখতে। আলীর ঘরের স্ত্রী ছিলেন বেলিন্ডার। বেলিন্ডার অভিযোগ, আলী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তার মধ্য থেকে মানবিকতা ও বিনয়ের সব চিহ্ন হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি এমন আচরণ করেছেন যেন তিনি ঈশ্বর।ক্ষুব্ধ বেলিন্ডার অভিযোগ, ‘তুমি নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি করতে পারো। কিন্তু তুমি কখনোই আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ হতে পারবে না’।
একজন স্কুলশিক্ষিকা তার শিক্ষার্থীকে যেভাবে নির্দেশ দেন, বেলিন্ডা ঠিক সেভাবেই আলীকে তখনই বসে একটি প্রবন্ধ লিখতে বলেন, যেখানে তাকে লিখতে হবে কেন তিনি মুসলিম হয়েছিলেন। আলী স্ত্রীর নির্দেশ মেনে কয়েক পাতা সাদা কাগজ আর একটা নীল কলম নিয়ে লিখতে শুরু করেন।
জীবনীকার জোনাথান ইগ বেলিন্ডার (বর্তমানে খলিলাহ কামাচো-আলী) সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সেই প্রবন্ধ লেখা কাগজগুলো পান।
আলী চিঠিতে লুইসভিলেতে তার কৈশোরের কথা উল্লেখ করেন। তখন তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। তখন রাস্তা দিয়ে স্কেটিং করার সময় ফুটপাতে কোনো সুন্দরী নারী হেঁটে যাচ্ছে কি না, তা নজরে রাখতেন তিনি।
এভাবেই একদিন রোলার স্কেটিং করে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কালো ব্লেজার স্যুট পরা একজনকে নেশন অফ ইসলামের জন্য পত্রিকা বিক্রি করতে দেখেন। আলী নেশন অফ ইসলাম এবং তার নেতা এলিজা মুহাম্মদের নাম আগেও শুনেছেন। কিন্তু কখনোই ওই দলে যোগ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সেভাবে ভাবেননি। দলটি কৃষ্ণাঙ্গদের বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং আত্ম-উন্নয়ন বিষয়ক নানা ধরণের প্রচারণা চালাত।
আলী একটি পত্রিকা ভদ্রতার খাতিরে বেশ উদাসীনভাবে হাতে তুলে নিলেন। হঠাৎ সেখানের একটি কার্টুনের দিকে তার চোখ যায়। সেখানে একজন শেতাঙ্গ মালিক তার কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মারধর করে তাকে যিশুখ্রিস্টের কাছে প্রার্থনা করতে চাপ দিচ্ছে। সেই কার্টুনের মূলকথা ছিল, শেতাঙ্গরা জোর করে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দিচ্ছে। প্রবন্ধে আলী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেননি। বরং একে তিনি বাস্তবতার আলোকেই তুলে ধরেন।
আলী বলেন, ওই কার্টুন তাকে জাগিয়ে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন, খ্রিস্টধর্ম তার পছন্দ নয়। ক্যাসিয়াস ক্লে নামটিও তার পছন্দ নয়। তিনি বুঝতে পারেন তিনি স্বেচ্ছায় এ ধর্ম গ্রহণ করেননি। তিনি নিজে তো তার নাম ক্যাসিয়াস ক্লে রাখেননি। তাহলে কেন তাকে ওই দাসত্বের চিহ্নগুলো বহন করতে হবে? আর তিনি যদি তার ধর্ম এবং নাম না বহন করতে চান তাহলে কী পরিবর্তন তিনি আনতে পারেন?
১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে বক্সিংয়ে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশীপ জেতার পর আল জনসম্মুখে ঘোষণা করেন তিনি নিজে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহ এবং শান্তিতে বিশ্বাস করি। আমি শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় ঢুকতে চেষ্টা করব না। কোনো শেতাঙ্গ নারীকে বিয়েও করতে চাই না। মাত্র ১২ বছর বয়সে আমাকে খ্রিস্টান বানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন আমি বুঝতে পারিনি আমি কী করছি। আমি এখন আর খ্রিস্টান নই। আমি জানি আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি সত্য কী তা জানি। তোমরা আমাকে যা বানাতে চাও আমাকে তা হতে হবে না। আমি যা হতে চাই সে ব্যাপারে আমি আজ মুক্ত।’
হেরে গিয়েও জয়ী যিনি
১৯৮০ সালে শিষ্য ল্যারি হোমসের কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিতে আলী রিং-এ ফেরেন। কিন্তু ১১ রাউন্ড পর আলী পরাজিত হন। পরে জানা যায় মস্তিষ্কে মারাত্মক ত্রুটি ধরা পড়েছে। তার মস্তিষ্ক ফুটো হয়ে গিয়েছিল। পরে তিনি ১৯৮১ সালে পুরোপুরি অবসর গ্রহণ করেন এ অবিসংবাদিত সেরা মুষ্টিযোদ্ধা।
মোহাম্মদ আলী ক্লে ১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই সফরে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামের নাম তার নামে রাখা হয়। ১৯৮০ সালে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হন এ মুষ্টিযোদ্ধা। হাসপাতালে যাওয়া-আসাটা পরিণত হয়েছিল নিয়মিত ব্যাপারেই। ৩২ বছর পারকিনসন্স রোগে ভোগার পর ২০১৬ সালের ৩ জুন ৭৪ বছর বয়সে মারা যান। তবুও আজ তিনি সম্মানিত। পেশাদার হেভিওয়েট বক্সিংয়ে সব কীর্তি তাকে পরিণত করেছে সর্বকালের অন্যতম সেরা বক্সিং তারকায়।