বেগম রোকেয়া দিবস আজ
স্বামীর অর্থে স্কুল স্থাপন করেন রোকেয়া, আয়ত্ত করেন ইংরেজি ভাষা
- আমান উল্যাহ আলভী
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৯ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪০ PM
বেগম রোকেয়া একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। যিনি মুসলমান নারীদের পর্দার অন্তরাল থেকে মুক্ত করে পাদপ্রদীপের আলো নিয়ে এসেছিলেন। ১৯ শতকে নারীশিক্ষাকে জাগ্রত করার জন্য যে সমস্ত নারীরা উদ্যোগী হয়েছিলেন সারা ভারতবর্ষে বেগম রোকেয়া তার মধ্যে অন্যতম।
এক কথায় তাঁকে প্রথম বাঙালি নারীবাদী ও মুসলমান নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। তাঁর বাবা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন জমিদার।
তিনি নিজে উর্দু, হিন্দি, আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিলেন। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দুই ছেলে ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিসুর রহমান সাবেরকে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভির্য়াস স্কুলে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে কোন উদ্যোগই নেননি।
রোকেয়ার মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেয়া চৌধুরানি। রোকেয়ার বড় বোনের নাম করিমুন্নেসা ও ছোট বোন হলেন হুমায়ারা। করিমুন্নেসা বিয়ের পর কবি হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেন। ছোট থেকেই রোকেয়া ও তাঁর বোনেদের লেখাপড়ায় প্রবল উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল। সেই সময়ে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ ছিল না। সেই কারণে রোকেয়ার প্রাথমিক শিক্ষা কোন প্রতিষ্ঠানে হয়নি।
বাড়িতেই বড় দাদারা যখন পড়তেন সেই সময় বাবাকে লুকিয়ে তাঁদের পড়া শুনে শুনে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে রোকেয়া মায়ের সাথে কলকাতায় এলে তখন বাড়িতেই মেম ডেকে পড়াশোনা করার সুযোগ ঘটে। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের কটাক্ষের কারণে সেই পড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তাঁর মা।
পড়ার প্রতি রোকেয়ার অসীম আগ্রহ দেখে তাঁর বড় ভাই ও বড় বোন এগিয়ে আসেন। মূলত তাঁদের সহযোগিতায় রোকেয়া আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলা ভাষার সাথে পরিচিত হন। তাঁর বড় বোন বিদ্যানুরাগী ছিলেন।
রোকেয়ার জীবনে তাঁর বড় বোন ও বড় দাদার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাবার নজর বাঁচিয়ে রোজ রাত্রে বড় দাদার কাছে পড়তে যেতেন দুই বোন। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে যান। বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। আর বড় বোনের মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন তাঁর বাবা। রোকেয়ার আসল শিক্ষা শুরু হয় বিয়ের পরে। আঠেরো বছর বয়সে আটত্রিশ বছর বয়সী ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সৈয়দ শাখাওয়াত ছিলেন রয়েল অ্যাগ্রিকালচার সোসাইটি অফ ইংল্যান্ডের সদস্য। রোকেয়া ছিলেন তাঁর স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী।
তাঁর প্রথম পক্ষের একটি মেয়ে ছিল। পরবর্তীকালে রোকেয়া ও শাখাওয়াতের দুটি মেয়ে হয়, কিন্তু তাঁদের শৈশবেই মৃত্যু হয়। তাঁর স্বামীর দেওয়া অর্থেই পরবর্তীকালে বেগম রোকেয়া স্থাপন করেন শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। মূলত তাঁর স্বামীর উৎসাহে ও সহযোগিতায়তেই ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেন রোকেয়া। ইংরেজি শেখার ফলে দেশ বিদেশের বহু লেখকের রচনার সংস্পর্শে আসেন তিনি। যা তাঁকে পরবর্তীকালে ইংরেজিতে সাহিত্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।
তাঁর স্বামী ছিলেন উর্দু ভাষী। সেই কারণে তাঁর উর্দু ও হিন্দি ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। কিন্তু বাংলা ছিল তাঁর প্রাণ। বাংলা ভাষায়তেই তিনি নিজের রচনাগুলো করে গেছেন। বেগম রোকেয়ার সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামক গল্পের মাধ্যমে। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় তাঁর স্বামীর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায়। তাঁর দ্বিতীয় সাহিত্যকর্ম একটি হাস্যরসাত্মক রচনা ‘মতিচুর’। এই প্রবন্ধে তিনি নারী পুরুষদের সমান অধিকার নিয়ে সরব হন। এটি গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে নবনূর, সওগত, মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তাঁর লেখনিতে যুক্তির সঙ্গে হাস্যরস মিলিত থাকত। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সাহায্যে সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে তিনি প্রতিবাদী হন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ এক অভাবনীয় লেখনী। সেই যুগে দাঁড়িয়ে যেখানে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা দিবা স্বপ্ন ছিল সেখানে তিনি বলেছিলেন “যে কাজ পুরুষ করতে পারে সেই কাজ নারীও করতে পারবে।”
তাঁর এই ধারণা যে কতখানি দুরদর্শীসম্পন্ন ছিল তা সময়ের সাথে প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রবন্ধটিকে ইউটোপিয়ান সাহিত্যের এক ক্লাসিক নিদর্শন বলে মনে করা হয়। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘পদ্মরাগ’। এই প্রবন্ধটি উনি বড় ভাই ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবেরকে উৎসর্গ করেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অবরোধবাসিনী’। এই প্রবন্ধে তিনি পর্দাপ্রথা নিয়ে সোচ্চার হন, সমালোচনা করেন পর্দাপ্রথার।
নারীকে শিক্ষিত হতে হবে এবং নিজের পছন্দ মত পেশা বেছে নিতে হবে, না হলে নারীর মুক্তি নেই এই কথা তিনি সোচ্চারে বলেন ‘অবরোধবাসিনী’ প্রবন্ধে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, বঙ্গভঙ্গ, খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও তাঁর কলমে ফুটে ওঠে সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা ‘চাষার দুঃখ’ ও ‘এন্ডিশিল্প’ প্রবন্ধে। ১৯০৯ সালে বেগম রোকেয়ার স্বামীর মৃত্যু হয়। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমৃত্যু পিছিয়ে পড়া নারীদের অগ্রগতির কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। নারীকে শিক্ষিত করে মানুষ হিসেবে তার পূর্ণ অধিকার অর্জনে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া।
১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেন রোকেয়া। তাঁর স্বামীর নামে স্কুলের নাম দেন “শাখাওয়াত মেমোরিয়াল” । কিন্তু তাঁর স্বামীর প্রথম পক্ষের মেয়ে ও জামাইয়ের তরফ থেকে প্রবল আপত্তির কারণে স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। কলকাতায় এসে ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনে আটজন ছাত্রী নিয়ে আবার শুরু করেন ” শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল” যা আজ কলকাতার প্রথম সারির মেয়েদের স্কুলগুলির মধ্যে অন্যতম।
প্রথমদিকে স্কুলে ছাত্রী হত না। রোকেয়া নিজে পর্দাপ্রথার বিরোধী হলেও স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বাড়ানোর জন্য পর্দাসীন হয়েই তিনি মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে অনুরোধ করতেন মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য। তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। ১৯১৬ সালে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা একশ পেরিয়ে যায়। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে যোগদান করে বাংলা ভাষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বক্তৃতাও দেন যা সেইসময়ে দাঁড়িয়ে এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল।
১৯১৬ সালে মুসলমান বাঙালি নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি নারী সংগঠন করেন নাম দেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’। এই সংস্থা বিধবা নারীদের শিক্ষা দান ও তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করা এবং দরিদ্র নারীদের বিয়ের খরচ ও শিক্ষা দানে কাজ করত। এইভাবে তিনি সমাজের অসহায় মেয়েদের পাশে নিজের সবটুকু শক্তি উজাড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তাঁর জন্মদিনেই বেগম রোকেয়ার মৃত্যু হয়।
বেগম রোকেয়া তাঁর জীবিত অবস্থায় কোন স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশে “রোকেয়া দিবস” হিসেবে পালিত হয়। ঐদিন বাংলাদেশের স্কুল কলেজ সব ছুটি থাকে। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে স্থাপন করা হয়েছে “রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র” যা বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দ্বারা পরিচালিত।
বাংলাদেশের সমাজে বিশেষ অবদানের জন্য অভাবনীয় স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের তরফে জাতীয় সম্মান “বেগম রোকেয়া পদক” দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি একটি ভোটের আয়োজন করে শতাব্দীর সেরা বাঙালিদের যেখানে ছয় নম্বরে স্থান পান বেগম রোকেয়া।
তাঁর ১৩৭তম জন্মদিনে গুগল একটি ডুডল তৈরি করে তাঁকে সম্মান জানায়। যেখানে দেখা যায়, বেগম রোকেয়া সাদা শাড়ি পরিহিতা হয়ে একটি বই নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় যার নাম ২০০৯ সালে রাখা হয় “বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়”।