শিগগিরই টাকার অভাবে মারা যাবো, তখন সবাই দেখতে আসবে

  © সংগৃহীত

মেয়েকে বাঁচাতে আর বাবা-মায়ের আকুতি নয়, এবার তাদের আহাজারিতে ভাসিয়ে চলে গেলেন সাদিয়া সুলতানা। আজ শনিবার (৭ ডিসেম্বর) ভোর সোয়া ৩টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের আলোক হেলথ কেয়ারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

সরকারি তিতুমীর কলেজের রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন সাদিয়া। ক্যান্সারের কাছে হেরে এবার পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। কোলন ও ওভারি ক্যান্সারে ভুগে শেষে ভোরে মারা গেছেন তিনি। দুপুর ১২টায় কলেজ ক্যাম্পাসে সাদিয়ার জানাযা অনুষ্ঠিত হবে বলে তার সহপাঠী ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে।

মৃত্যুর আগে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চেয়ে নানাভাবে আকুতি জানিয়েছিলেন তিনি। গত ১১ অক্টোবর তার সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসেও ছিল সেই আকুতি। তিনি লিখেছিলেন, ‘খুব শীঘ্রই হয়তো টাকার অভাবে আমিও মারা যাবো, আর তখন সবাই ঠিকই আমাকে দেখতে আসবে। কিন্তু সময় থাকতে খুব কম মানুষই সাহায্যের হাত বাড়াবে।’

তার সেই কথায় সত্যি হলো। না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এখন তাকে অনেকেই স্মরণ করছেন। সাদিয়ার ওই স্ট্যাটাসটি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

সেখানে নুর-ই-আলম সিদ্দিক নামে একজন মন্তব্য করেছেন , ‘ভালো হইছে এই সমাজ থেকে চলে গেছে, উপরে অবশ্যই ভালো থাকবেন দোয়া করি অনেক অনেক। একদিন আসলেই মধ্যবিত্ত সবাইকে টাকার অভাবে মারা যেতে হবে।’

মন্ময় মজুমদার মন্তব্য করেছেন, ‘জীবিত থাকতে কেউ ভাল থাকতে বলেনি, ভাল রাখতে পারেনি, সবাই পরকালে ভাল থাকতে বলে।’  ইমরান হোসেন লিখেছেন, ‘সর্বশেষ তোমার কথাটিই সত্যি হলো, বোন। আজ লোকের অভাব নেই।’

গত ২০ জুলাই কিছু গিফটের ছবি দিয়ে আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন সাদিয়া। সেখানে তিনি লেখেন, ‘বরাবরের মতই ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। আঙ্কেল আমাকে অনেক স্নেহ করেন সেটা সবাইই জানে, আর আমি তো আরও ভালো করে জানি। তাই আজকেও চলে আসার সময় আঙ্কেল বললো, দাঁড়াও সাদিয়া, এতো জলদি কেনো যাওয়ার? দাঁড়াও দেখি তোমাকে কোনো গিফট দেওয়া যায় কি না।

তারপর এগুলো গিফট হিসেবে দিয়ে দিলো। আগেও এমন অনেক কিছু গিফট হিসেবে দিয়েছেন আঙ্কেল। সত্যি ই জানি না কতোদিন বাঁচবো। কিন্তু এই যে যেখানেই যাই সেখানেই সবাই এতো ভালোবাসে এর থেকে বড় পাওয়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই। এভাবে সবার ভালোবাসা নিয়ে চলে যাওয়াও সবার কপালে থাকে না। আসলেই জীবন সুন্দর। সত্যিই অনেক সুন্দর।’

২০১৮ সালে মে মাসে পরীক্ষার কেন্দ্রে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সাদিয়া। পরে তাকে প্রথমে উত্তরা মহিলা মেডিকেল ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন সেখানে চিকিৎসার পরেও অবস্থার অবনতি হলে উত্তরার আর এমসি হাসপাতালে জরুরি অপারেশন করা হয়।

অপারেশনে কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। মাঝে কিছুদিন ভালো ছিলও সাদিয়া। নিয়মিত নিজের ক্লাস ও টিউশনিও করেছে। কিন্তু ফের রমজানের আগে আবার ব্যথা শুরু হলে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান বিদ্যুতের তত্ত্বাবধানে আলোক হাসপাতালে বিশোর্ধ্ব সাদিয়ার চিকিৎসা চলছিল।

কয়েকদিন আগে সাদিয়ার মা কামরুন নাহার জানান, ৮টি কেমোথেরাপির পর আরও একটি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে ক্যানসার সমস্ত পেটে ও জরায়ুতে ছড়িয়ে পড়ছে।

এর মাঝে আমরা কলকাতার টাটা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় আবার দেশে চলে আসি। এখন মেয়ের পা ফুলে মোটা হয়ে গেছে। পেটও ফুলে গেছে। ব্যথায় অস্থির। এক ঢোক পানি ছাড়া কিছুই খেতে পারছে না। আমার মেয়েটা সব সময় মানুষের সেবায় কাজ করেছে। মানা করলেও অন্যকে রক্ত দিত।

কিছুদিন আগেও বন্ধুবান্ধব নিয়ে মরণব্যাধি ‘ক্যানসার সচেতনতা ও স্বেচ্ছায় রক্তদান’ কর্মসূচি করেছিলেন সাদিয়া সুলতানা। নিজেও একাধিকবার মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিয়েছেন। একনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বেচ্ছায় রক্তদানের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাঁধনের কার্যক্রমে। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী সাদিয়া সুলতানাই আজ মরণব্যাধি ক্যানসারের কাছে পরাজিত হয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।


সর্বশেষ সংবাদ