গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১০০ সাংবাদিক

গাজা যেন সাংবাদিকদের জন্য মৃত্যুকূপ
গাজা যেন সাংবাদিকদের জন্য মৃত্যুকূপ  © সংগৃহীত

গাজায় বর্বর ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ১০০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও আনেকে। হামলার আগে গাজায় প্রায় ১০০০ সাংবাদিক নিয়োজিত ছিলেন। এই হিসাবে মোট সংবাদকর্মীর প্রায় ১০ শতাংশ মারা গেছেন এরই মধ্যে। এ এলাকাটি কার্যত এখন সাংবাদিকদের মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। খবর আলজাজিরা 

গত অক্টোবরের শেষ দিকে আলজাজিরার সাংবাদিক ওয়ায়েল দাহদুহ যখন গাজা যুদ্ধ নিয়ে লাইভ করছিলেন, ঠিক সে সময়ই বর্বর ইসরায়েলিদের বিমান হামলায় তাঁর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও নাতি নিহত হন। এ খবরে কেঁদে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। ওই সাংবাদিক বেঁচে গেলেও ইহুদিবাদী দেশটির আগ্রাসন প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে সংবাদকর্মীদের প্রাণ। গাজার সাংবাদিকদের জন্য যুদ্ধের সংবাদ প্রচার এবং ব্যক্তিগত দুঃখ এক অভিন্ন গল্প। যাদের ভাগ্য প্রসন্ন, সেই সাংবাদিকরাও প্রতিনিয়ত তাদের স্বজন ও সহকর্মীদের হারাচ্ছেন। আর হতভাগ্যদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি বোমা।

সাংবাদিকদের বলা হয়, বিশ্বের চোখ ও কান। অথচ হামাস পরিচালিত গাজার মিডিয়া অফিস গত শনিবার বলেছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মুহাম্মাদ আবু হায়েদি নিহত হয়েছেন। তিনি এ উপত্যকায় এবার নিহত ১০০তম সাংবাদিক। তবে গাজার কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত সংবাদকর্মীর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

অবশ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) বলছে, গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধে এ পর্যন্ত অন্তত ৬৯ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন। সিপিজে জানায়, আরও ১৫ জন আহত, কর্তব্যরত অবস্থায় তিনজন নিখোঁজ এবং ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টের ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি টিম ডসন আলজাজিরাকে বলেছেন, আমরা এই সংঘাতে যত সাংবাদিকের মৃত্যু দেখেছি, তা আর কোথাও ঘটেছে বলে আমি মনে করি না। ১০০ সাংবাদিকের মৃত্যু একটি অভূতপূর্ব সংখ্যা।

ডসন বলেন, গাজার সাংবাদিকদের শুধু ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও নোটবুক রয়েছে এবং এই হৃদয়বিদারক মৃত্যুর সংখ্যা সত্ত্বেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েল সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করছে কিনা– জানতে চাইলে ডসন বলেন, কিছু ফিলিস্তিনি সাংবাদিক তাঁকে বলেছেন, তারা হুমকিমূলক কল পেয়েছেন। সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, তাদের বা তাদের পরিবারকে আগামী দিনে লক্ষ্যবস্তু করা হবে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে এসব কল এসেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন সিপিজে বলেছে, গাজায় সাংবাদিকদের হত্যার সংখ্যা ইতিহাসে ‘অতুলনীয়’। সংস্থাটি বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামলা চালিয়ে সাংবাদিকদের এমন হারে হত্যা করছে, যার তুলনা আধুনিক ইতিহাসে নেই।সিপিজে বিবৃতিতে বলেছে, এ যুদ্ধের প্রথম ১০ সপ্তাহে ক্ষুদ্র গাজায় যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তা এ সময়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি। অর্ধেকেরও বেশি মৃত্যু ঘটেছে যুদ্ধের প্রথম মাসে। এটি ১৯৯২ সালে সাংবাদিকদের মৃত্যুর রেকর্ড রাখা শুরু করার পর থেকে সবচেয়ে প্রাণঘাতী একক মাসে পরিণত হয় গত অক্টোবর। সিপিজে একে ‘ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাংবাদিক ও তাদের পরিবারকে লক্ষ্যবস্তু করার একটি আপাত-ধরন’ বলে অভিহিত করেছে।

সিপিজের প্রেসিডেন্ট জোডি গিন্সবার্গ বলেছেন, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে নিহত সাংবাদিকদের হার সিপিজের ইতিহাসে অতুলনীয়। সেখানে গণমাধ্যমের জন্য পরিস্থিতি যে কতটা গুরুতর, এটাই তা নির্দেশ করে। গাজায় নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যা ইউক্রেন, ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের থেকেও বেশি।স্থানীয় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরা তাদের জীবনের ভয় তুচ্ছ করে গাজা থেকে রিপোর্ট করে চলেছেন।সিপিজে বলেছে, ইরাকই একমাত্র দেশ, যা গাজায় বর্তমান মৃত্যুর সংখ্যার কাছে পৌঁছেছিল। উপসাগরীয় দেশটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে তিন বছরে ৫৬ সাংবাদিক নিহত হন।

সাংবাদিকের আরেক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) অভিযোগ করেছে।প্যারিসভিত্তিক এ সংগঠনটির গত শুক্রবার দায়ের করা অভিযোগে হেগের এ আদালতকে ২২ অক্টোবর থেকে ১৫ ডিসেম্বর গাজায় নিহত সাত ফিলিস্তিনি সাংবাদিকের মৃত্যুর তদন্ত করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

এদিকে গাজায় যেসব সাংবাদিক বেঁচে আছেন, তাদের জীবনও এক বেদনাদায়ক আখ্যানে পরিণত হয়েছে। যেমন, ইসরায়েলি বিমান হামলায় আলজাজিরা অ্যারাবিকের গাজা ব্যুরোপ্রধান ওয়ায়েল দাহদুহ তাঁর স্ত্রী, সাত বছরের মেয়ে এবং ১৫ বছরের ছেলে ছাড়াও আটজন আত্মীয়কে হারিয়েছেন। তবে স্ত্রী-সন্তানদের কবর দিয়ে সাগরসমান শোক বুকে নিয়েই তিনি আবারও ফিরে গেছেন রণাঙ্গনে, ইসরায়েলি হামলার বিভীষিকা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। গাজার সব সাংবাদিকই তাঁর মতো দৃঢ়প্রত্যয়ী।

 


সর্বশেষ সংবাদ