নেপালে হঠাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তন, কেন?

নেপালের ম্যাপ
নেপালের ম্যাপ  © সংগৃহীত

এক.
নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কেপি শর্মা অলিকে নেপালের সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে নেপাল পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা, নেপাল কংগ্রেস পার্টির প্রধান শের বাহাদুর দেউবাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দেউবা এর পূর্বেও চারবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন।হঠাৎ করে কেন সরকার পরিবর্তনের মতো ঘটনা নেপালে ঘটে গেল? যেখানে সরকারের মেয়াদই এখনো শেষ হয়নি? জানা যাচ্ছে, এনসিপি বা নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির দুই নেতার ক্ষমতার অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বেই প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পতন হলো। ২০১৮ সালের মে মাসে নেপালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বে দুটি কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি যা এনসিপি নামে পরিচিত। সদ্য বরখাস্তকৃত প্রধানমন্ত্রী কেপি অলি ছিলেন এই এনসিপির নেতা। গত সংসদ নির্বাচনের আগে যে দুটো কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় সেগুলো হচ্ছে -কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট)। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের নেতা ছিলেন সাবেক গেরিলা যোদ্ধা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড।তিনিও নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুটো দল একীভূত হয়ে এনসিপি নামে নির্বাচনে জয়ী হলে কেপি শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রী হন।তাদের মধ্যে চুক্তি ছিল পূর্ণ মেয়াদের অর্ধেক সময় নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন এনসিপি পার্টির দুই প্রভাবশালী নেতা কেপি শর্মা অলি এবং মাওবাদী সাবেক গেরিলা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড। কিন্তু কেপি শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রী এবং নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির প্রধানের পদ-কোনোটাই পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডকে দিতে রাজী হচ্ছিলেন না। সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। এছাড়া এনসিপির প্রভাবশালী নেতা মাদব কুমার নেপালও কেপি শর্মা অলির প্রতি একটা পর্যায়ে এসে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এনসিপি অলরেডি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে গেছে।

দুই.
নেপালের সদ্য বরখাস্তকৃত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি প্রথম দিকে ছিলেন কট্টর চীনপন্থী, যদিও পরে ভারত-চীনের সাথে ভারসাম্য ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। এনসিপির আরেক নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডপও ছিলেন মাওবাদী কমিউনিস্ট। কিন্তু সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক চারবারের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ছিলেন নেপালি কংগ্রেস পার্টির নেতা।যিনি কট্টর ভারতপন্থী হিসাবে পরিচিত।মনে হচ্ছে এনসিপির অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বে নেপালে কমিউনিস্ট পার্টির পতন হলো কিন্তু বাস্তবতা আরো বেশি কিছু।

বিগত কয়েক বছরের রাজনৈতিক যে পরিবর্তন নেপালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট যে দেশটি চীন এবং ভারতের রাজনীতির দাবার গুটিতে পরিনত হচ্ছে।দলে আদর্শিক জায়গা থেকে নেতৃত্বের জায়গাটা যখন বড় হয়ে দাঁড়িয়ে যায় যেকোনো রাজনৈতিক দলের পরিণতি তখন যা হয় এনসিপির ক্ষেত্রেও তাই হলো। সুযোগটা কাজে লাগাতে সক্ষম হলেন দেউবা, বিরোধী দলীয় নেতা শের বাহাদুর দেউবা হয়ে গেলেন আদালতের আদেশে নেপালের প্রধানমন্ত্রী।

তবে এই পরিবর্তনের পেছনে মাওবাদী কমিউনিস্ট গেরিলা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডের হাত রয়েছে বলেও জোড়ালো খবর বেরুচ্ছে।হাত আছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেরও। কেপি শর্মা অলির সমর্থকরা এই ঘটনার প্রতিবাদে নেপালে বিক্ষোভ করছে। নেপালের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করে ফেলা দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এটাকে অলির সমর্থকরা একটি ইনস্টিটিউশনাল ক্যু হিসাবে চিহ্নিত করছেন। সদ্য বরখাস্তকৃত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ছিলেন চীনের খুবই ঘনিষ্ঠ,প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারীও ছিলেন কেপি অলির খুব ঘনিষ্ঠ। নেপাল -ভারতের কিছু বিতর্কিত এলাকাকে (কালাপানি ও লিপুলেক) নেপালের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে অলি পার্লামেন্টে তা পাস করিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেন। এটি চীনকে খুশি করলেও ভারত বিষয়টা সহজ ভাবে নেয়নি।চীনপন্থী কেপি শর্মা অলিকে বরখাস্ত করে নেপালী কংগ্রেস পার্টির নেতা শের বাহাদুর দেউবাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর পেছনে ভারতের হাত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায়না কোনো ভাবেই। ভারত যে কেপি শর্মা অলিকে পর্দার আড়ালে থেকে একটি কন্সটিটিউশনাল ক্যুয়ের মাধ্যমে পতন ঘটিয়ে চীনের কাছে একটা বার্তা পাঠাচ্ছে এটা স্পষ্ট। কারণ নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা ভারতের (ট্রাস্টেড এন্ড টেস্টেড) বন্ধু। নেপালের সংকট একটি অভ্যন্তরীণ সংকট হলেও এই সংকটে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের ভূমিকা উড়িয়ে দেয়া যায়না, বরং বিগত কয়েক বছরের ঘটনা প্রবাহে এটা স্পষ্ট।

তিন.
নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি(এনসিপি)র দুই নেতা কেপি শর্মা অলি এবং পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ২০২১ সালের মে মাসে হঠাৎ পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নেপাল সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন বিরোধী দলীয় নেতা শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে বিরোধী এমপিরা।পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট কেপি শর্মা অলি কর্তৃক পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে বাতিল করে এবং পার্লামেন্ট পুনর্বহাল করে নেপাল কংগ্রেস পার্টির নেতা এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা শের বাহাদুর দেউবাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার আদেশ দেয় ১২ জুলাই ২০২১।শর্ত থাকে দেউবাকে ত্রিশ দিনের মধ্যে নেপালের পার্লামেন্টের সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে অর্থাৎ আস্থা ভোটে জিততে হবে। সেটাই হলো। ১৮ জুলাই ২০২১ পার্লামেন্টের আস্থা ভোটে যথেষ্ট ব্যবদানেই জিতলেন নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা। আস্থা ভোটে জিততে ২৭৫ সদস্য বিশিষ্ট নেপাল পার্লামেন্টে শের বাহাদুর দেউবার প্রয়োজন ছিল ১৩৬ ভোট কিন্তু তিনি পেয়েছেন ১৬৫ ভোট, তার বিপরীতে পড়েছে ৮৩ ভোট। বাকীরা ভোট দেননি। ফলে খুব সহজেই ২০২২ সালের পার্লামেন্ট ইলেকশন পর্যন্ত সময়ের জন্য দেশ বাহাদুর দেউবা নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন এটা নিশ্চিত।

নেপালের নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীকে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে কেন বরখাস্ত হতে হলো? সুপ্রিম কোর্টের পেছনেও কি কেউ ছিল?কী এমন শক্তি? এটা কি শুধুই নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরিণ দ্বন্দ্বের ফল? নাকি গভীরে আরো বেশি কিছু আছে? চীনপন্থী কেপি শর্মা অলির নেতৃত্বে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে নেপালের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে দায়িত্ব পালন করা যে সহজ হবে না তা পূর্বেই আন্দাজ করাই যাচ্ছিল। এশিয়া সামনের দিন গুলোতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে, বলা হচ্ছে খুব জোর দিয়েই। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি আমেরিকা ও চীনের নজর খুবই তীক্ষ্ণ। এ অঞ্চলে আমেরিকাকে এক ধরনের মৌন সম্মতির মাধ্যমে মেনে নিলেও চীনকে সহ্য করা ভারতের জন্য খুবই বিব্রতকর বিষয়। আমেরিকাও এখন তার দৃষ্টি চীনের দিকে ঘুরাচ্ছে। যা ভারতকে অতিরিক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এশিয়ায় ভারত এবং আমেরিকার শত্রু এক। তাহলো চীন। সুতরাং ভারতের পার্শবর্তী একটা দেশ নেপালে চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা কেপি শর্মা অলির প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নেতৃত্ব দেয়াটা চ্যালেঞ্জিং ই ছিল। সাথে যোগ হল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (এনসিপির) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ফলে যা হওয়ার তাই হলো।নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সরকারের পতন হলো। ভারত কি চীনকে হঠাৎ নেপালে রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ব্যাপারে চীনকে একটা বার্তা দিয়ে রাখলো?

রাজনীতিতে এখন আর অভ্যন্তরীণ সংকট বলতে কিছু নাই। প্রতিটা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের পেছনেই এক কিংবা একাধিক আন্তর্জাতিক শক্তি ইন্ধন যোগায় নিজেদের স্বার্থে। নেপালেও তাই হয়েছে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ