রাবি দিবসে প্রাণের দাবি— একজন সৎ ভিসি চাই
- গোলাম সারওয়ার
- প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২১, ০১:৩৭ PM , আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২১, ০১:৩৭ PM
আজ ৬ জুলাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এই দিবসের প্রাক্কালে আমাদের একটাই প্রাণের দাব— আর তা হলো, অতি দ্রুত একজন সৎ,নির্ভীক, নিষ্ঠাবান এবং পন্ডিত ব্যক্তিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক। যিনি হবেন শিক্ষার্থীবান্ধব এবং দুর্নীতিমুক্ত।সততা, কর্তব্য পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা যিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করবেন। তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নে অধিকতর মনোযোগী হবেন। প্রকৃতপক্ষে দেশের সর্বাধিক আলোচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে এমনই একজন ভিসি প্রয়োজন।
গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অশুভ কিছু বিষয়ে রেকর্ড গড়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর (অধ্যাপক) পদে পদোন্নতিতে সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষক এগিয়ে আছেন, পদোন্নতির নীতিমালা সহজীকরণের ফলে এমন ঘটনা ঘটছে।বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক পদ পর্যন্ত পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগে।
একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানসম্পন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা থাকার পরও তাদের অধ্যাপক হতে ২০/২৫ বছর পর্যন্ত সময় লাগে।অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির নীতিমালার বদৌলতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রফেসর হয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটা বিভাগে অন্যান্য পদবীর চেয়ে প্রফেসর পদের ছড়াছড়ি। যার কারণে শিক্ষকদের মান নিম্নমুখী হচ্ছে। শিক্ষা ও গবেষণায় পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।ছাত্র-শিক্ষক ও অধ্যাপকের অনুপাত হিসেব করলে সবচেয়ে এগিয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ঘোষিত পদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এখানে। নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের বিভক্তিতে এগিয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতায় রেকর্ড করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকদের নৈতিক স্খলনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের।
এমনকি সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে মৃত্যুর মিছিলের সারিতে মানুষ আতঙ্কিত, সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলেছে নানা দুঃখজনক ঘটনা। এই করোনাকালে বন্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে লাগানো দৃষ্টিনন্দন অনেকগুলো "পাম" গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।এই নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে। প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে ট্রাকে করে মাটি চুরি করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এতে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সম্মতিতে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৬ মে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটালো সাবেক ভিসি প্রফেসর আব্দুস সোবহান। তাঁর মেয়াদের শেষ দিনে নিজ ক্ষমতাবলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১৩৮ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা -কর্মচারীকে এডহকভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তিনি সমালোচনার সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছেন ।এই নিয়োগকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈধ ঘোষণা করেছে। যার জের এখনো চলছে।
নিয়োগকৃতরা যোগদানের জন্য এই লকডাউনের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। হুমকি,ধামকি দিয়ে আন্দোলন করে গুরুত্বপূর্ণ ফিন্যান্স কমিটির এবং সিনেটের সভা বন্ধ করে দিয়েছে বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। রুটিন দায়িত্বে থাকা উপাচার্য প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা এ ব্যাপারে কয়েকদিন আগে থানায় জিডিও দায়ের করেছেন। কিছু নামধারি শিক্ষকদের নানা অনৈতিক ঘটনায় বরেন্দ্র সভ্যতার প্রতীক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-সন্মান ধূলিস্ম্যাৎ হয়েছে।
চরম দূরাবস্থায় পতিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্গঠন করতে হলে কোনো সাধারণ মাত্রার ভিসির পক্ষে সম্ভব হবেনা। এখানে এমন একজন ভিসি নিয়োগ দিতে হবে, যিনি হবেন গণতান্ত্রিকমনা অত্যন্ত বলিষ্ঠচিত্তের অধিকারী; তাঁকে সুদক্ষ হাতে ধৈর্যের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মেধা-মনন এবং উৎকর্ষের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যিনি সম্পূর্ণ লোভের বাইরে থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চলার জন্য তাঁকে সতর্ক থাকতে হবে। যিনি দলীয় আনুগত্যের চেয়ে ছাত্র স্বার্থ রক্ষায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে অধিকতর মনোযোগী হবেন।তাঁকে ছাত্র-শিক্ষক বিভাজন ও অসুস্থ লেজুড়বৃত্তি রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। শিক্ষক কাম রাজনীতিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।নইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে পেপার পত্রিকায় যাদের নাম দেখতে পাচ্ছি,তাঁদের দ্বারা এমন বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ গড়া সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনদের মতামতে জানা গেছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদেরকে চিনেন এবং জানেন, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে অবহিত, এমন সিনিয়র কয়েকজন শিক্ষক এবং কর্মকর্তারা তাঁদের অভিমতে জানিয়েছেন, বর্তমানের এই অধঃপতিত বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্গঠন করা আলোচিত এইসব ভিসি পদ প্রত্যাশীদের দ্বারা কখনো সম্ভব নয়।
দলীয় এমপিদের মত শিক্ষকদের তদ্বিরের প্রদর্শনী, সক্রিয় নেতাকর্মী হিসেবে আমরা দেখতে চাই না।শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয় এবং আদর্শহীনতা আর দেখতে চাইনা। '৭৩-এর অধ্যাদেশের অপব্যবহার কিংবা অতিব্যবহারও আমরা দেখতে চাইনা।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য মূল ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকসমাজ। ভিসি নিয়োগ হন শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। সিনেট ,সিন্ডিকেট, ফাইন্যান্স কমিটি, একাডেমিক কমিটি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রতিটি কমিটিতে রয়েছেন এই শিক্ষকসমাজ। তাই শিক্ষকরা যদি প্রকৃত শিক্ষক হতে পারেন, অশিক্ষকসূলভ মনোভাব ত্যাগ করতে পারেন, তবেই এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত গড়ে উঠবে। আমরা শিক্ষকদের অনেক দালালি, নোংরামি দেখেছি।আর নয়, রাজশাহীবাসীর অহংকার, গৌরবমন্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের চাওয়া-পাওয়ার ন্যক্কারজনক প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক। তাঁদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক।
আমরা 'রাকসু' সক্রিয় দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত '৭৩-এর অধ্যাদেশ মোতাবেক ভিসিসহ সবরকম কার্যক্রম দেখতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা গণতান্ত্রিক চর্চার পীঠস্থান হিসেবে দেখতে চাই। শিক্ষক পদোন্নতি নীতিমালার আমরা পরিবর্তন চাই।
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এক সাক্ষাতকারে বলেন, "শিক্ষকদের অসুস্থ দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে দলাদলিতে লিপ্ত হওয়ার জন্য দায়ি সরকার,রাজনৈতিক দল,বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি শিক্ষকেরা নিজে"। আমরা আশা করি, জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে সব পক্ষের চৈতন্যোদয় হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে লেখা আছে, "একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য অ্যাটমিক বোমা লাগেনা।সবচেয়ে সহজ উপায় হলো,সে দেশের শিক্ষার মানকে নামিয়ে দাও।শিক্ষক-ছাত্রদের নীতিহীন করে দাও। তাতে দেখবা, ডাক্তারদের হাতে রোগীরা মারা যাচ্ছে।ইন্জিনিয়ারদের হাতে গড়া ভবন কোলাপ্স হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও এ্যাকাউন্টেন্টদের হাতে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে, ধর্মীয় স্কলারদের হাতে মানবতা ধ্বংস হচ্ছে। এককথায় শিক্ষা ধ্বংস মানে গোটা দেশ তথা জাতি ধ্বংস"।
তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি, আমলাদের ইচ্ছায় নয়, সরকারের উঁচু মহলের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টা গভীরভাবে নজরে এনে অতি সত্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীলমনা একজন সৎ, দক্ষ, নির্ভীক এবং দেশপ্রেমিক ভিসি নিয়োগ দেওয়া হোক।
লেখক: সাবেক কর্মকর্তা,রাবি এবং প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
ই-মেইল:golamss636@gmail.com