চাকরির বয়সসীমা বাড়াও!

সজীব ওয়াফি
সজীব ওয়াফি  © ফাইল ছবি

চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে চাকরিপ্রত্যাশীরা সমাবেশ করেছে। বলেছে তাদের দাবি বয়সসীমা না বাড়ালে আত্মহত্যা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। নানান কারণে তারা বিভিন্ন সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর কথা বলে আসলেও নীরব ছিল সরকারপক্ষ।

নির্বাচনী ইশতেহারে বয়সসীমা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে আলাপ উঠলে তা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত তরুণদের দাবির যৌক্তিকতা আরো জোরালো হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে।

আন্দোলনকারীরা বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে সমাবেশ করতে গেলে তাদের উপর হয়েছে লাঠিপেটা। গ্রেফতার হয়েছে এরকম অভিযোগও আছে। অভিযোগ আছে আন্দোলন নেতৃত্বদের হুমকি ধামকি পাওয়ার। তারা নতুন করে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে মিছিল মিটিং নাগরিকদের অধিকারগুলোর অন্যতম। দাবি নিয়ে মিছিল-মিটিং করলে সেখানে কেন হেনস্তা হতে হবে!

বাংলাদেশ কোভিড-১৯ আক্রান্তের পূর্বে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ। আটকে থাকা অনার্স-মাস্টার্সের পরীক্ষাগুলো একযোগে অনুষ্ঠিত হলে নতুন কয়েক লাখ যোগ হবে এর সাথে। করোনা সংকটে পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞপ্তিও ৮৭ থেকে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। পদের সংখ্যাও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। অর্থাৎ আগে যেখানে ১০০ জন নিয়েছে, এখন সেখানে শতকরা ৪০ জন নিচ্ছে। মোটকথা তুলনামূলক বেকার সমস্যাও বেড়েছে বহুগুণে।

প্রেসক্লাবের সামনে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও মন্ত্রণালয়কে স্মারকলিপি দেওয়া এবং শাহবাগসহ বেশকিছু জায়গাতে দীর্ঘদিন যাবৎ কর্মসূচি করে আসছিল চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা। তাদের দাবি, চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে হবে। করোনা মহামারির প্রভাবে চাকরির বিজ্ঞপ্তি শুরু থেকেই বন্ধ, আবেদনকৃত পূর্বেকার পরীক্ষাগুলোও এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৫ মাস ধরে চাকরির রিক্রুট প্রক্রিয়া একেবারেই স্থবির। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতিতে চাকরিপ্রত্যাশীদের কোনো হাত নেই।

যাদের বয়স শেষাশেষির কোঠায় ছিল, তাদের আবেদনের বয়সসীমা শেষ। উদ্বিগ্ন হতাশ এসব শিক্ষার্থীদের জানানো হয়েছিল, তাদেরকে দেওয়া হবে ব্যাকডেটে আবেদনের সুযোগ। কিন্তু এ বছরের শুরুর দিক থেকে এ পর্যন্ত দু-একটা সার্কুলার যা এসেছে, তাতে ব্যাকডেটের সুযোগ ছিল অনুপস্থিত। তাদের হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে ইতোমধ্যে তাদের একটা চাকরির জোগাড় হয়ে যেত।

অন্যদিকে ব্যাকডেট সুবিধায় সমন্বয় করে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম। কারণ চাকরির বাজার অস্বাভাবিক মাত্রায় সংকুচিত হয়েছে। নতুনদের সংকুলান করতেই সেখানে সরকারকে খেতে হবে হিমশিম। দ্বিতীয়ত বয়সসীমা শেষ বা শেষের কাছাকাছি হওয়ায় সময়সীমা নির্ধারণ না করে দিয়ে ব্যাকডেট সুবিধা হতাশাগ্রস্ত থেকে তরুণদের উত্তরণ করতে পারবে না। হতাশা নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকে থাকাও মুশকিল।

মহামারি পরবর্তী নিজস্ব উদ্যোগের বাস্তবায়ন করাটাও কঠিন। মাছ চাষ, পশুপাখি পালন, খামার করতে এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকার থেকে পরামর্শ দিলেও মুষ্টিমেয় সংখ্যক বাদে সকলের জন্যই তৈরি করবে বিরূপ পরিবেশ। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশটাই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের পক্ষে মূলধন যোগানের পাশাপাশি আছে এসব সেক্টরের বাস্তব জ্ঞানের অভাব। সরকার থেকে তরুণদের সহজলভ্য ঋণ প্রদানের কথা বলা হলেও সকলের পক্ষে সেটা পাওয়া অসম্ভব। খামার করার মত অনেকেরই নেই নিজস্ব কোন জায়গা জমি।

বর্তমানে চলমান শিক্ষার্থীদেরও চাকরির বয়সসীমা নিয়ে ভোগান্তি হবে না, এরকম চিন্তার কারণ নেই। বরং বয়স না বাড়ালে তাদেরকেও এর রেষ পোহাতে হবে। কারণ তাদের শিক্ষাজীবনেও হারিয়ে যাচ্ছে ২ বছরের মূল্যবান সময়। ফলে চাকরি প্রস্তুতিতেও ২ বছর সময় কম পাবে। তাদের জন্য হাতছানি দিচ্ছে দিশেহারা ভবিষ্যৎ।

স্থায়ীভাবে বয়স বাড়ানো অসম্ভব হলে চাকরিতে প্রবেশ করেনি এমন তরুণদের ক্ষেত্রে প্রণোদনা হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে করোনাকালীন ২ বছরকে লুপ্ত বছরের হিসাব। এক্ষেত্রে মূলতঃ সুযোগ পাবে যারা চাকরিতে প্রবেশ করেনি, সেই সকল বেকার এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা। তাহলে যারা চাকরিতে একবার প্রবেশ করেছে, তাদেরও সমস্যা হবে না। নতুবা বয়স বাড়ালে চাকরিতে প্রবেশ করেছে, এসকল প্রার্থীরাই আবার নতুন করে জট সৃষ্টি করবে।

জরুরি ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না করলে বিপুল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? আমাদের বেসরকারি খাতও এত পরিমাণে নাজুক যে, তাদেরকে এই মুহূর্তে সেখানে কাজে লাগানোর চিন্তা করা অসম্ভব। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি প্রার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সীমা ৩২-এ কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না হলে সাধারণ প্রার্থীদেরও সমস্যা না হওয়ার কথা। কোটার প্রার্থীদের বয়সও তুলনামূলকভাবে বাড়ানো যেতে পারে।

এমতাবস্থায় উপর্যুপরি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে পরিবার এবং সমাজের কাছে বিদ্রুপের শিকার হতে হবে তরুণদের, বোঝা হয়ে দাঁড়াতে হবে; বেছে নিতে হবে আত্মহত্যার পথ। মানসিক অবস্থা ভেঙে গিয়ে জিডিপিতে অংশ নিতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না বিরাট সংখ্যক এই ভুক্তভোগীরা। জাতীয়ভাবে ঘটবে শ্রমশক্তির অপচয়।

করোনার চলমান ঢেউ কতদিন নাগাদ থামবে ঠিক নেই। আন্দোলনকারীদের সচেতন থাকতে হবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোটার সাথে যেন তুলনা করা না হয়। সরকারকে খুঁজতে হবে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র। আন্দোলন সংগ্রাম না করলে কেন দাবি আদায় হয় না! চাকরির বয়স স্থায়ীভাবে বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে দাড়িয়েছে। কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে ক্ষতিগ্রস্ত হাজারও বেকার তরুণ।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ