খাদ্য নিরাপত্তায় প্রাণিসম্পদের গুরুত্ব: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
- ডা. মো. ইব্রাহীম খলিল
- প্রকাশ: ০৮ মে ২০২০, ০৫:৫৫ PM , আপডেট: ০৮ মে ২০২০, ০৫:৫৫ PM
বর্তমান বিশ্ব বড্ড পরিবর্তনশীল, এ পরিবর্তনের ছোঁয়া জাগতিক সকল বিষয়কেই স্পর্শ করছে। এর থেকে বাদ নেই মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের বিশ্বাস বা খাদ্যাভ্যাস। বিশ্বের মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সচেতনতা। সময় যত গড়াচ্ছে তারা নিজেদেরকে উদ্ভুদ্ধ করছে গুণগত সম্পন্ন খাদ্য অভ্যাসের প্রতি।
মূলত মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আরবানাইজেশনের কারণে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে গত এক দশক ধরে। এ কথার স্বপক্ষে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। তারা জানিয়েছেন আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে খুব জোরালো একটি সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্যদ্রব্য হিসেবে প্রানীজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা বিশেষ করে দুধ,মাংস ও ডিম গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধিতে।
যদি আমরা শহরের নাগরিক বৃন্দের দিকে একটু খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাব দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদিত রকমারি খাবারের প্রতি তাদের আসক্তি কি রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ১০ জন ব্যক্তির ভিতর ৭ জন ব্যক্তি শহরে বসবাস করবেন। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর ২০০৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্বেই প্রাণীজ আমিষের সরবরাহ বেড়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বেড়েছে কয়েকগুণ হারে। এর প্রেক্ষিতে গত ১০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দানাদার খাদ্যের মাধ্যমে ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা ৬০ ভাগ থেকে দাঁড়িয়েছে ৫৪ ভাগ।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে ২০৩০ সাল নাগাদ এটা আরও কমবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর বরাত দিয়ে জানিয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ মাংস এর মাধ্যমে ক্যালরি গ্রহণটা বাড়বে দ্বিগুণ হারে এবং এর পাশাপাশি অন্যান্য সকল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের মাত্রা প্রায় স্থির থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জার্নালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এর বরাত দিয়ে উদাহরণ হিসাবে বলা হয়, এশিয়া মহাদেশে জনপ্রতি প্রাণীজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ২২৫ শতাংশ, ১৯৬১ থেকে ২০০৭ সালের সাথে তুলনা করে এ তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এর বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রানিসম্পদের খাতের পণ্যসমূহ খাদ্য হিসাবে দ্রুত গ্রহণ করার কারণে গত চার দশকে মৎস্য থেকে উৎপাদিত খাদ্য সমূহ গ্রহণ সামান্য কমেছে।
এ সকল কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রাণিসম্পদ বিভাগের উপরে অতিরিক্ত চাপ বাড়বে। এই চাপ বাঁড়ার অন্যতম আরো একটি কারণ হলো, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য খাদ্যে অ্যামাইনো এসিডের যে চাহিদা পূর্বে নিরূপণ করেছিল তা এখন বহুগুণ বেড়ে গেছে, কারণ হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাণীজ আমিষ ওজন কমাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি কার্যকর শরীর গঠনে সহায়তা করে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০০৬ সালে এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, বিশ্বে মাংস এবং দুধ উৎপাদিত পণ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়বে যথাক্রমে ১০২ ও ৮২ শতাংশ, ২০০০ থেকে ২০৫০ সালের ব্যবধানে। কিন্তু, এসব পণ্যের উৎপাদনের হার উন্নয়নশীল দেশে আরো বেশি থাকবে এবং তা যথাক্রমে হবে ১৬৪ এবং ১৭২ শতাংশ।
উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি গত তিন দশকে জনপ্রতি মাংস ও মাংস উৎপাদিত পণ্য গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে ১৫০ ভাগ এবং দুধ ও দুধ উৎপাদিত পণ্যের গ্রহণের মাত্রা বেড়েছে ৬০ ভাগ। ২০৩০ সাল নাগাদ জনপ্রতি মাংস ও মাংস উৎপাদনের হার বাড়বে আরও ৪৪ ভাগ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আরো জানিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে যেখানে ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে জনপ্রতি বাৎসরিক মাংস গ্রহণ ছিল ২৫.৫০ কেজি সেখানে ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৩৭ কেজি এবং দুধ ও দুধ উৎপাদিত পণ্য ৪৫ কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬৬ কেজি ও ডিম গ্রহণের পরিমাণ হবে ৬.৫ কেজি থেকে ৮.৯ কেজি।
এটাতো হলো উন্নয়নশীল দেশসমূহে চিত্র,শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি অভিক্ষেপণ করেছে। এগুলো হবে মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশসমূহ আদর্শ জীবন ব্যবস্থা এর প্রতি সচেতন হওয়ার কারণে।
এবার আসি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮-২০১৯ এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী মাংস উৎপাদন ছিল ৭৫.১৪ লক্ষ মেট্রিক টন, দুধ ৯৯.৩ লক্ষ মেট্রিক টন ও ডিম ছিল ১৭১১ কোটি। শুধু এক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে নয়, যদি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের গত ৮ বছরের (২০০৯-২০১৭) বার্ষিক রিপোর্টের দিকে লক্ষ্য করলে এ সকল পণ্যের ক্রমবর্ধমান চিত্র সহজে স্পষ্টীকরণ হয়।
গত এক দশকে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন বেড়েছে যথাক্রমে ৪.৩ গুন, ৭ গুন ও ৩.৬ গুন, যেখানে জনপ্রতি দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদার প্রেক্ষিতে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ১২৫ গ্রাম, জনপ্রতি দৈনিক ২৫০ মিলি দুধের চাহিদার প্রেক্ষিতে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ১৬৫ মিলি ও জনপ্রতি বছরে ১০৪ টি ডিমের চাহিদা সম্পূর্ণ পুরণ হচ্ছে।সকল তথ্য-উপাত্তের প্রেক্ষিতে এ কথা স্পষ্ট বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে থাকবে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় আমাদেরকে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রজেকশনের দিকে খেয়াল রেখে এই সেক্টরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আরো কিছু কর্ম পরিকল্পনা হাতে নেওয়া একান্ত জরুরী।
১) প্রাণিসম্পদ উৎপাদিত পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে জরুরী প্রতিষ্ঠানে রূপদান করার মধ্য দিয়ে খামারিদের পাশে থেকে সপ্তাহে ২৪ ঘন্টা সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে সকলের কাছে বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
২) গ্রাম পর্যায়ে প্রাণীদের চিকিৎসা ও পরামর্শ সার্বক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ সেবা সম্প্রসারণ করার জন্য আমাদেরকে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩) দেশের বিভিন্ন এলাকায় উন্নত মানের গবেষণাগার ও পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা।
৪) দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয় ডেইরি ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন, জাতীয় পোল্ট্রি ডেভলপমেন্ট করপরেশন ও জাতীয় বিফ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন নামক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হলে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
৫) প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ইপিডেমিওলজি ইউনিটকে আরো শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে খামারিদের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার হাত থেকে অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে।
৬) খামারিদের উৎপাদিত পণ্য সুষ্ঠুভাবে বিপণনের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আলাদা বিপণন প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরী, যা এই মহামারীর সংকটকালে এর প্রয়োজনীয়তার বাস্তব চিত্র সকলের মাঝে ফুটে উঠেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাণিসম্পদ খাত আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মানবদেহের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলও সরবরাহ করে থাকে। সর্বোপরি, দুধ, মাংস ও ডিম মানুষের মেধা বিকাশের অন্যতম হাতিয়ার। মেধাবী জাতি যদি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তবে মেধা-মননকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য সেক্টরগুলো কে এগিয়ে নিয়ে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব হবে ২০৪১ সালের আগেই।স্কটিশ কবির খাবারের পূর্বের প্রার্থনা দিয়ে শেষ করতে চাইঃ
Some have meat and cannot eat.
Some no meat but want it.
We have meat and we can eat and
so the Lord be thanked.
লেখক: ভেটেরিনারি সার্জন, বিসিএস (প্রাণিসম্পদ), ডিভিএম (সিভাসু), এম এস ইন এনিম্যাল এন্ড পোলট্রি নিউট্রিশন