একটি ভিত্তি প্রস্তরের আত্মকথা

  © টিডিসি ফটো

ছবিতে যে ভিত্তি প্রস্তরটি দেখা যাচ্ছে সেটি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ভিত্তি প্রস্তর। যা স্থাপন করা হয়েছিল ২০০১ সালের ১৩ জুলাই। এটিই বশেমুরবিপ্রবির প্রথম ইমারত বা ইট পাথরের স্তম্ভ। এই ভিত্তি প্রস্তরের সূত্র ধরেই আজ ৫৫ একর জুড়ে বিরাট অট্টালিকা, এক মহা কর্মযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির দিক দিয়ে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।

ভিত্তি প্রস্তরকে একটি প্রকল্পের সূতিকাগার বলা হয়। বশেমুরবিপ্রবির এই ভিত্তি প্রস্তরটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এটি অন্যান্য ভিত্তি প্রস্তর থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার একটি ইট পাথরের ইমারত। জাতির জনকের নামে উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর হওয়ায় স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাত থেকে বাদ পড়েনি ইট পাথরের ইমারতও। বশেমুরবিপ্রবির এই ভিত্তি প্রস্তর তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম প্রক্রিয়ায় যেমন কল্যাণীর মমতার ছোঁয়া আছে, তেমনি অকল্যাণীর তীক্ষ্ণ নখরাঘাতের চিহ্নও আছে। বশেমুরবিপ্রবির জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশের যেসব জেলায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই তেমন ১২টি বৃহত্তর জেলায় ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার গ্রহণ করে। প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়। এই ছয়টির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প ছিল অন্যতম। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বেশ দ্রুততার সাথেই।

যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করে গোপালগঞ্জে পাঠানো হয়। প্রকল্প পরিচালক তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন, জমি অধিগ্রহণ এবং জমি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেন। ইতোমধ্যে ২০০১ সালের ৮ জুলাই মহান জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণীত হয়।

১৯ ফুট জলাশয় বালু ভরাট করে তৈরি করা হয় কাঙ্ক্ষিত ভিত্তি প্রস্তর। ২০০১ সালের ১৩ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে ১৪ জুলাই তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে নিয়োগের সুপারিশ করেন এবং রাষ্ট্রপতি ১৯ জুলাই ২০০১ উক্ত নিয়োগ অনুমোদন করেন।

আওয়ামীলীগ সরকারের মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি লতিফুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান গোপালগঞ্জ, রংপুর ও রাঙ্গামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। এরপরেও গোপালগঞ্জবাসী স্বপ্ন দেখতেন তাদের নিজ জেলায় জাতির জনকের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, যার ভিত্তি প্রস্তর ইতোমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে।

কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে জামাত-বিএনপির চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তারা ২০০২ সালের ১৫ এপ্রিল জাতির জনকের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বন্ধ ঘোষণা করে। ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানের নিয়োগ বাতিল করে তাঁকে তাঁর পূর্বের প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের নির্দেশ দেয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সকলে ধরেই নিয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্টের হয়তো মৃত্যু ঘটেছে।

৫৫ একর জুড়ে ধু ধু বালুভুমি, তার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি ভিত্তি প্রস্তর। নিজ জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে স্বপ্ন তা হয়তো অধরাই থেকে যাবে গোপালগঞ্জবাসীর। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকে বশেমুরবিপ্রবির ভিত্তি প্রস্তর। গোপালগঞ্জবাসীর মনে শঙ্কা দেখা দেয়, ভিত্তি প্রস্তর থেকে আদৌ কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বাস্তবায়িত হবে কিনা তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এরপর কেটে গেছে প্রায় সাত বছর। ভিত্তি প্রস্তরটিও এতদিনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে তাকে হয়ত ভেঙ্গে ফেলা হবে, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয় অর্জন করে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে এলে জাতির জনকের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্যাকাশ থেকে আমনিশার ঘোর অন্ধকার কাটতে শুরু করে। সকলের আশঙ্কাকে মিথ্যে প্রমাণ করে ২০০৯ সালের নভেম্বরে স্থগিত প্রকল্পটি পুনর্জীবিত করা হয় এবং নতুন সূর্যেরে আলো দেখতে শুরু করে ভিত্তি প্রস্তরটি।

২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে আবারও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করে। পরবর্তীতে ২০ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ আইন-২০০১ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসআরও জারী করে এবং ১৪ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে পুনরায় চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পকে। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে ড.এম খায়রুল আলম খানের মেয়াদ শেষ হয়।

২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ খান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে পুনরায় তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

২০১১ সালে মাত্র পাঁচটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩৪টি বিভাগ রয়েছে এবং আসন সংখ্যায় এটি এখন বাংলাদেশের চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তিতেও শীর্ষে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে এবং প্রতিবছর ভর্তির সুযোগ পায় প্রায় শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের সহায়তার দিক থেকেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উদ্যোগে কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থ হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হয় এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা। এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও অনুকরণীয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র পাঁচ বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মরুময় ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সব থেকে বড় উদ্ভিদ সংগ্রহশালায়। বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে প্রায় ২২ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি


সর্বশেষ সংবাদ