একজন শিল্পীর মৃত্যুতে কীভাবে সব মানুষ এক হয়, উদাহরণ জুবিন গার্গ

মোজাফ্ফর হোসেন
মোজাফ্ফর হোসেন  © টিডিসি সম্পাদিত

কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে মারা যান ভারতের জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গার্গ। সিঙ্গাপুরে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে স্কুবা ডাইভিং করার সময় শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতায় তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে পুরো আসাম নেমে এসেছে রাজপথে। পুরো আসাম কাঁদছে। কে বিজেপি, কে কংগ্রেস, কে হিন্দু, কে মুসলিম—কোনো ভেদাভেদ নেই। পৃথিবীর আর কোনো শিল্পী তার নিজের শহরে এতটা ভালোবাসা পেয়েছেন কিনা জানি না। কোনো গণনেতা কিংবা জননন্দিত মানুষের মৃত্যুতে পৃথিবীর কোনো শহর এভাবে পথে নেমেছে কিনা জানি না।

আসামের প্রতিটি রাজনৈতিক দল শোক জানিয়েছে। শোক জানিয়েছে ক্রিকেট দল থেকে শুরু করে সব ধরনের সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও। এমনকি ব্যবসায়ীরা দোকানপাঠ বন্ধ করে শোক পালন করছে। আসাম সরকার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছে। শেষকৃত্য না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করেছে। ফুড ডেলিভারি সার্ভিস থেকে শুরু করে সব বন্ধ।

কফিন কাঁধে নিয়ে অসমের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গান গাইছেন। অসমের ডিজিপি নিজে রাস্তায় নেমে ভিড় সামলাচ্ছেন। পুলিশকর্মীরা কাঁদছেন জনগণের সঙ্গে। কিন্তু তিনি তো আমাদের শিল্পীদের মতো সরকারি শিল্পী ছিলেন না। বাংলাদেশে এক সরকার এসে আগের সরকারের শিল্পীদের কালো তালিকাভুক্ত করে নিজের কিছু শিল্পী সচল রাখেন।

জুবিন তেমন শিল্পী ছিলেন না। আসামে যখন ULFA ফতোয়া জারি করেছে হিন্দি গান গাওয়া যাবে না, তিনি মঞ্চে হিন্দি গান গেয়েছেন। জুবিন মদ খেয়ে মঞ্চে উঠতেন। হিসাব করে কথা বলতেন না। একজনের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি CAA ও NRC বিরোধী আন্দোলনেও সরব ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের শিল্পীদের মতো জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে বসে থাকেননি। প্রয়োজনে সব সময় সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। নানা সময়ে সরকারবিরোধী বক্তব্য রাখতে পিছপা হননি। এমনকি ধর্মে বিশ্বাস করেন না, সেটাও প্রকাশ্যে বলেছেন।

কিন্তু তাতে তো জনপ্রিয়তা হারানোর কথা। তাহলে কারণটা কী? সরকারের সমালোচনা করে থাকলে তার বিদায়ে সরকারিভাবে কেন এত আয়োজন? কেন সব রাজনৈতিক ব্যানার একত্রিত হয়েছে শোক জানাতে? হিন্দুধর্মের সমালোচনা করলে হিন্দুধার্মিকরা কেন তার শোকে মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন? আমাদের দেশে হলে তো হয়তো মুসলমানরা কবর থেকে লাশ তুলে পোড়াতেন।

আমি বুঝতে না পেরে আসামের লেখক ফেসবুকবন্ধু Dr. Parinita Bora-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানকার সেন্টিমেন্টটা। তিনি জানালেন, জুবিন সমাজসেবক, মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেতেন না। অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অভাবীদের সাহায্য করতেন। সকল বয়সী মানুষের জন্য গান গেয়েছেন। প্রকৃতি এবং প্রাণীদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালোবাসা। ফিল্মফেয়ার এবং আইফা-এর মতো পুরস্কার জিতেও খ্যাতির মোহে আসাম ছেড়ে যাননি। অসমীয়া সিনেমার সবচেয়ে খারাপ সময়েও তিনি অসমীয়া সিনেমার সুদিন ফিরিয়ে এনেছিলেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগাতেন। দুর্ঘটনায় আহত পাখি, পশু-পাখিদের বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা করতেন, আশ্রয় দিতেন।

আসামের লেখক Samar Deb জানালেন, ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে পৈতে ত্যাগ করেছেন। ধর্ম, জাতপাতের ঊর্ধ্বে ছিলেন। সমস্ত অমঙ্গলের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, ব্যবসায়ী—কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না।

আমরা অনেকে তার ভক্ত হয়েছি ‘ইয়া আলী’ শুনে। কেউ কেউ বাংলা গান ‘বোঝে না সে বোঝে না’ দিয়ে তাকে চিনেছেন। আমি অহমিয়া ভাষায় পাপনের গান শুনতে শুনতে জুবিনের ‘জোনাক জোনাক’ গানটি পেয়েছি। এই গানটি আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি। কিন্তু তাকে চিনতাম না। জুবিন গর্গ না জুবিন নটিয়াল, সেটাও গুলিয়ে যেত। কিন্তু তার মৃত্যু তাকে নতুন করে চেনালো। নতুন করে চিনলাম আসামের মানুষকে।

আমাদের দেশে কোনো শিল্পী মারা গেলে চোর-ডাকাত-দুর্নীতিবাজ লোকজন মোরাল পুলিশিং শুরু করে। নিজের পাপের জায়গা হয় না কিন্তু প্রয়াত শিল্পীর জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে ওয়াজ করতে থাকে। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় বুদ্ধিজীবীরা সেই শিল্পী কতটা দলদাস ছিলেন সেই হিসাব করে শোককর্ম করেন। সম্প্রতি ফরিদা পারভীনের মতো জনপ্রিয় শিল্পীর মৃত্যু হলো, আমরা কি করেছি? রাষ্ট্র কি করেছে? আমরা পারি খালি বিভাজন সৃষ্টি করতে। চেতনার চোটে একদিন সবকিছু ভেসে যাবে, এখনও টের পাচ্ছি না আমরা।

যাই হোক, শিল্পী জুবিনের পাশাপাশি আসামের লোকজনের প্রতি ভালোবাসা জানাই। জুবিন নাকি বলেছিলেন তার মৃত্যুতে আসাম কাঁদবে সাত দিন ধরে। কিন্তু এতটা কাঁদবে, এভাবে কাঁদবে তা হয়তো তিনি নিজেও বোঝেননি। শিল্পীর বিদায় এভাবেই যাপন করা উচিত।

মোজাফ্ফর হোসেন: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ