মাদ্রাসার ভেতরের স্নিগ্ধতা: যে শিক্ষা বই পড়ে পাওয়া যায় না
- রিফাত আহমেদ
- প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৪:৪৩ PM , আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:২০ PM
১৬ জুলাই ২০২৫। শ্রীবরদী উত্তর বাজার তাহফীজুল কুরআন মাদ্রাসার হাফিজ ও মাওলানা আব্দুল হান্নান ভাই আমাকে তাঁর মাদ্রাসায় আমন্ত্রণ জানান। যদিও ফেসবুকে আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন, তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল না। কিন্তু যখন জানালেন যে মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের সবক প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবো, তখন অন্তর থেকে ভালো লাগা কাজ করল। বলেছিলাম, “এমন একটি জায়গায় আপনি আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন—এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। ইনশাআল্লাহ, আমি আসব।”
২০ জুলাই সেই সবক প্রদান অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। বাদ মাগরিব থেকে এশার পর পর্যন্ত আমরা মাদ্রাসায় অবস্থান করি। খুবই সাদামাটা, অনাড়ম্বর আয়োজন। কিন্তু এর মাঝেও ছিল এক গভীর মায়া আর প্রশান্তি। মাদ্রাসার পরিবেশ যেন মনের উপর এক ধরনের স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দেয়। আলেম-উলামাদের সাথে এশার নামাজ আদায়ের সৌভাগ্য হয়েছিল সেদিন।
অনুষ্ঠান শেষে খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিজ হাতে রান্না করা বিরিয়ানি ও মুগডাল। স্বাদে-ঘ্রাণে, আন্তরিকতায় এমন তৃপ্তি হয়েছিল—যা বড়লোকদের রাজকীয় আয়োজনে পাওয়া যায় না।
আরও হৃদয়গ্রাহী ছিল তাদের ব্যবহার ও আদবের শিক্ষা। আমি ও আমার একজন সহকর্মী মিলে গিয়েছিলাম। আমাদের এগিয়ে আনতে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছিল মাদ্রাসার তিনজন শিক্ষার্থী। যত্ন করে আমাদের গাঁয়ের মেঠোপথ পেরিয়ে ছায়াঘেরা সেই প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, এই মাদ্রাসাটি যেন ফুলের একটি বাগান, আর প্রতিটি শিক্ষার্থী সেই বাগানের একটি করে নরম সুন্দর ফুল। চোখে জল এনে দিয়েছিল একটি ক্ষুদ্র ঘটনা। ফেরার সময় দেখলাম—আমাদের ও অন্যান্য অতিথিদের জুতা, যা আমরা বাইরে খুলে রেখেছিলাম, সেগুলো মাদ্রাসার ছাত্ররা ঘরের ভিতরে এনে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। এটাই তো আদব। যে শিক্ষা শুধু বইয়ে থাকে না—জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রকাশ পায়।
২৪ জুলাই আবারও দুটি মাদ্রাসায় পবিত্র কুরআন বিতরণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে। সেদিনও একই রকম অভিজ্ঞতা—ভিন্ন মাদ্রাসা, কিন্তু এক স্নিগ্ধ অনুভব।
হাজারো অনটন, অর্থনৈতিক সংকট, শিক্ষক-বেতন বকেয়া থাকলেও কোনো অভিযোগ নেই। নেই মুখ ভার করে থাকা। শিক্ষকরা নিরবে কাজ করে চলেছেন—মানুষ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে। কেউ হয়ত সাত-আট হাজার টাকা বেতন পান না, বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে থাকে, তবুও হাসিমুখে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত থাকেন।
এক মাদ্রাসায় যখন উপহার হিসেবে কুরআন বিতরণ চলছিল, তখন ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীরা আমাদের দেওয়া চাটাইয়ে রাখা বিছানায় পা না দিয়ে, ফ্লোরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে উপহার নিচ্ছিল। আমরা বলেছিলাম, “পা দাও না, সমস্যা নেই।” তাদের শিক্ষকও বলেছিলেন, “এটুকু সমস্যা হবে না।”
কিন্তু তবুও তারা পা রাখেনি। এই যে ছোট ছোট আচরণ, এগুলোই একদিন তাদেরকে করে তুলবে আলোকিত মানুষ—যেখানে ডিগ্রিধারী অনেক বড় বড় মানুষরাও ব্যর্থ হয়ে যায়।
কিন্তু আশ্চর্য লাগে, কোনো মাদ্রাসায় বিচ্ছিন্ন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলেই এক শ্রেণির মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তারা যেন সুযোগ খুঁজে বেড়ায়, কীভাবে পুরো মাদ্রাসা ব্যবস্থা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের এক ঢালায় অপবাদ দেওয়া যায়। অথচ ঠিক এমনই ঘটনা জেনারেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে—সেখানে তাদের মুখে কুলুপ!
আসলে যারা মনের কোমলতা হারিয়ে ফেলেছে, তাদের চোখে ভালো কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আমরা যেন এমন না হই। মহান আল্লাহ যেন আমাদের মনকে কোমল রাখেন। যদি কারও হৃদয়ে সিলমোহর পড়ে থাকে—তা যেন খুলে দেন, আমিন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (রসায়ন), শ্রীবরদী সরকারি কলেজ, শেরপুর।