শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সম্পর্কে চিড়, উত্তরণের পথ

মো. শামসুল আলম 
মো. শামসুল আলম   © টিডিসি ফটো

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এটা একদিনে তৈরি হয়নি। বিগত দেড় দশকে এই সম্পর্ক মোটামুটি তলানিতে ঠেকে গিয়েছে। আর এর জন্য কি শুধু শিক্ষক দায়ী? নাকি শিক্ষার্থীরা দায়ী? নাকি অন্য কোন তৃতীয়,  চতুর্থ  পক্ষ দায়ী আছে সেটা আলোচনার দাবি রাখে।

বর্তমান যাদের বয়স ৩০ বা তদূর্ধ্ব তারা যেমন শিক্ষককে সম্মান করেছেন, মেনে চলেছেন এখন শিক্ষার্থীরা কি সেটা করে? (মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতীত)। যদি না করে থাকে তার জন্য কি শিক্ষার্থীরাই শুধু দায়ী? মোটেও না। শিক্ষকদের ব্যর্থতাও আছে। ২০ বছর আগে, যে কারিকুলাম ছিল শিক্ষকরা সেই অনুযায়ী পাঠদান করিয়েছেন। 

কিন্তু বর্তমান যে কারিকুলাম আছে, সে অনুযায়ী শিক্ষকরা উপযুক্ত পাঠদান করতে সক্ষম হচ্ছেন না। কারণ, কারিকুলাম বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা সেটা কেমনভাবে নিবে? নেতিবাচক হচ্ছে কিনা সেটা বিবেচনা করা হচ্ছে না। নতুন নতুন কারিকুলাম নিয়ে এসেই শুধু ইতিবাচক দিক বিবেচনা করা হচ্ছে আর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উপর এর থেকে ভালো ফল বের করে আনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এমনকি এ কারিকুলাম প্রণয়নের আগে তাদেরকে ঠিকমতো সসম্পৃক্ত করা বা মতামত নেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু সেখান থেকে ভালো আউটপুটের দায়িত্বটা তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আদৌ নতুন কারিকুলামের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কিনা সে দিকটা বিবেচনা করা হচ্ছে না।

যেদিন শিক্ষকতা পেশায় যোগদান শিক্ষকরা করেন, সেইদিন থেকে তার ক্লাস নেওয়া শুরু! কী অদ্ভুত না ব্যাপারটা!। ক্লাস নেওয়া একটা আর্ট ও কঠিন কাজ। তিনি তখন জানেনই না, টিচিং মেথড, স্টাইল, টেকনিক, পাঠ পরিকল্পনা ইত্যাদি কীভাবে প্রস্তত করতে হয়। আর পাঠদানকে সহজভাবে ভাবলে তো শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখবেনা। অথচ একজন  শিক্ষককে যেদিন এ পেশায় প্রবেশ করছেন সেদিন থেকেই প্রশিক্ষণ ব্যতীত তাকে ক্লাস নিতে হচ্ছে। তিনি জানেনই না কীভাবে তার শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া উচিত। তাহলে ভালো ক্লাস  তিনি কীভাবে নিবেন?

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ফিনল্যান্ড, জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে চাই। কিন্তু শিক্ষকরা জানেই না বা জানানোই হয় না সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতি কেমন? প্রাকটিক্যাল নলেজ নেই, সেখানকার পরিবেশ, আর্থসামাজিক অবস্থা কেমন, সেই কারিকুলামে কীভাবে আমাদের দেশে পাঠদান করা উচিত। কিছুই জানেনা। সবই উপর থেকে এসে পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপর। 

তাদেরকে ঠিকমতো  ধারণা দেওয়া হয় না নতুন কারিকুলামে আসলে কোন দিকটা ফোকাস করা হচ্ছে । যদিও মুষ্টিমেয় কিছু ট্রেনিং দেওয়া হয় সেটাও অপর্যাপ্ত, প্রয়োজনের তুলনায় ১০-২০ শতাংশ হবে কিনা সন্দেহ। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এগুলোতে কিছু ট্রেনিং হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন ও হয় যে কোন শিক্ষক চাকরিজীবনে  কোনোদিন ট্রেনিং ই পায় নাই।

কখনো কি ভেবে দেখেছি শিক্ষকতার উপর প্রশিক্ষণ ব্যতীত একজন ভালো শিক্ষক পাবো কীভাবে? আবার শিক্ষক ভালো ক্লাস না নিতে পারলে, শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে কেন সে শিক্ষকের ক্লাস করবে?

নতুন কারিকুলাম দিচ্ছি অপর দিকে সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছি না। ক্লাস সাইজ কেমন হওয়া উচিত? মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম প্রস্তুত করে দিচ্ছি কিনা? বা সেগুলোর ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে কিনা  বা এইটার ব্যবহার শিক্ষকরা করতে পারে কিনা সেটাও যাচাই  করিনা। শিক্ষকতাকে বলা হয় 
একটি জীবন দীর্ঘ শেখার প্রক্রিয়া’। আবার বলা হয় মহৎ পেশা।

তাহলে কি আমরা তাদেরকে উক্ত সেবাই সর্বদা মনোনিবেশ করত পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা দেই? উপরের উক্তি ২ টি সত্য হলে তাদের শুধু নির্দিষ্ট পেশায়  মনোনিবেশ করাতে চাইলে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে। যাতে তারা সন্তুষ্ট হয়ে নিজেদের পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন।এবং অন্য কোন ব্যবসা বা  পেশায় নিজেদেরকে নিযুক্ত না করেন।

আবার বিগত  বছরগুলোতে সরকারের মন্ত্র ছিল ‘যত বেশি পড়িবে, তত বেশি জানিবে, তত কম মানিবে’। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও কোথাও অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে সেখানে দলদাস, লেজুড়বৃত্তি একটা শ্রেণির উদ্ভব ঘটিয়েছে। যা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙ্গে ফেলেছে।  

ভিন্নমতের কারণে শিক্ষার্থীরা যেমন মারধর, হয়রানি, মামলার শিকার হয়েছে, কিন্তু শিক্ষকরা তাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি। তেমনি শিক্ষকরা ও মারধর, মামলা, হয়রানি,এমনকি জুতার মালা ও পরেছে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা ও কিছু করতে পারেনি।

রাষ্ট্রযন্ত্র এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যে মসজিদ কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি এমন লোক হত যারা অনেকেই নামাজ পড়তো না। স্কুলগুলোতে ম্যানেজিং কমিটিতে থাকতো তাদের মধ্যে অনেকেই শুধু সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ছিল। তাহলে শিক্ষার অবস্থা কেমন ছিল কিছুটা অনুমেয়। শিক্ষাঙ্গনে কি এগুলো চলতে পারে? সেখানে শিক্ষার পরিবেশ কেমন ছিল? শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মাঝে সংকট হবে না কেন?

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, পেশিশক্তির ব্যবহার ও আরো বিবিধ কারণ আছে যেগুলো এই আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এ আস্থার সংকটের ফলশ্রুতিতে কি হচ্ছে? শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অপদস্থ করছে, সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে, যেটা অতীতেও ছিল এখনো  চলছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। শিক্ষকরাও তাদের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগলে রাখতে পারছেন না। এমতাবস্থায় সমাধান কী?

এই আস্থা ফিরে পেতে কিছু সুপারিশ হলো- শিক্ষা ব্যবস্থার নেতৃত্ব শিক্ষা বা শিক্ষকতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিতে হবে। এমন একটি কারিকুলাম প্রণয়ন করা, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী বান্ধব হবে। কারিকুলাম প্রস্তুতকরণে মাঠ পর্যায়ে ফিজিবিলিটি টেস্ট ( সেখানকার আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষকের গুণগত বৈশিষ্ট্য, শিক্ষার্থীর ধরণ বিবেচনা) করতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষকতার উপর (কারিকুলাম বেইজড) পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে,  শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়ার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট গুলো সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়াও শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক  গবেষণা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে 
শিক্ষকতা পেশাকে স্বাধীন করতে হবে। ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিকমুক্ত ঘোষণা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের জন্য পিপাসা থাকতে হবে। শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মাঝে স্নেহ- শ্রদ্ধার সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence