পিএসসির পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে

ড. মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ
ড. মো. মোর্ত্তূজা আহমেদ  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) পরীক্ষা হলো সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রধান মাধ্যম। এ পরীক্ষার মাধ্যমে দেশব্যাপী সরকারি চাকরিতে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয়। তবে, বর্তমান পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ থাকায় পরীক্ষার পদ্ধতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা তিনটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়: প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্ন থাকে, লিখিত পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিস্তারিত প্রশ্ন থাকে এবং মৌখিক পরীক্ষায় প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞান মূল্যায়ন করা হয়।

এই পদ্ধতির কিছু সুবিধা আছে। যেমন- ব্যাপক প্রার্থীভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া। তবে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন- পরীক্ষার সময়সীমা দীর্ঘ হওয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অস্পষ্টতা এবং প্রাসঙ্গিক জ্ঞান মূল্যায়নের সীমাবদ্ধতা। আরও একটি সমস্যা হলো প্রশ্ন ফাঁস, যা পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়নে বাধা সৃষ্টি করে।

বর্তমান পরীক্ষার পদ্ধতিতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা সময়ের সাথে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। প্রথমত, পরীক্ষার ধরন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রায়শই আধুনিক চাকরি বাজারের চাহিদার সাথে মিলে না। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক দক্ষতা ও জ্ঞান মূল্যায়নের জন্য নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও প্রক্রিয়ার দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে সৃষ্ট অসুবিধা। চতুর্থত, প্রশ্ন ফাঁস একটি বড় সমস্যা যা পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।

এছাড়া, মেধার যথাযথ মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষার সাথে প্রার্থীর শিক্ষাজীবনের ফলাফল যেমন এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স এবং মাস্টার্সের মেরিট স্কোর যুক্ত করে মেরিট লিস্ট তৈরি করা উচিত। এটি পরীক্ষার্থীদের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করবে এবং মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে। এসব কারণে পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার পদ্ধতিতে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমেই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক উন্নত দেশ অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের মূল্যায়ন করে। অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত এবং সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়, যেমন অটোমেটেড সিস্টেমের মাধ্যমে উত্তরপত্র মূল্যায়ন।

অন্য উদাহরণ হিসেবে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি চাকরির পরীক্ষা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়, যা পরীক্ষা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে। এটি বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিষয়বস্তু ও প্রশ্নপত্রের সংস্কার করতে হবে যাতে তা বর্তমান চাকরি বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, ডাটা অ্যানালিটিক্স, এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যা বর্তমান চাকরি বাজারের চাহিদার সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে। নতুন মডেলের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরি করা যেতে পারে যা দক্ষতা ও জ্ঞানের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করতে সক্ষম।

উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল মাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বরং ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও প্রকল্পভিত্তিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও জ্ঞান মূল্যায়ন করা হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- প্রশ্ন ফাঁসরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। উদাহরণস্বরূপ, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে যা প্রতিটি প্রশ্নপত্রের তৈরি ও বিতরণ প্রক্রিয়াকে সুরক্ষিত ও স্বচ্ছ রাখে।

এছাড়া, পরীক্ষা কেন্দ্রে বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ এবং নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার করে পরীক্ষার পরিবেশকে নিরাপদ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে এই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সমস্ত উদাহরণগুলো বাস্তবায়িত হলে পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার পদ্ধতি আরও উন্নত, স্বচ্ছ এবং দক্ষ হতে পারে। পরীক্ষার ফলাফল ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী নিয়োগের জন্য একটি বহুমুখী ও সমন্বিত মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অতিরিক্ত মেধা মূল্যায়নের জন্য প্রার্থীর এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স এবং মাস্টার্সের ফলাফল যুক্ত করে একটি সামগ্রিক মেধা তালিকা তৈরি করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া, প্রার্থীর ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা পরীক্ষা করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যের সিভিল সার্ভিস ফাস্ট স্ট্রিম প্রোগ্রামে প্রার্থীদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও দলবদ্ধ কাজের দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়। প্রকল্পভিত্তিক কাজের নমুনা ও পোর্টফোলিও যাচাই করে প্রার্থীর পূর্ববর্তী কাজের অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, পোর্টফোলিও ভিত্তিক মূল্যায়ন যা প্রার্থীর কাজের দক্ষতা ও অর্জনগুলোকে প্রদর্শন করে। অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত ও নির্ভুল মূল্যায়ন করা সম্ভব, যেমন GRE বা GMAT পরীক্ষায় অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফলাফল প্রকাশ করা এবং বিস্তারিত স্কোর কার্ড প্রদান করা উচিত, যেমন SAT পরীক্ষার ফলাফল অনলাইনে প্রকাশ করা হয় এবং পরীক্ষার্থীরা তাদের স্কোর বিস্তারিতভাবে জানতে পারে। এই সমন্বিত মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী বাছাই করা সম্ভব হবে।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি। আধুনিক চাকরি বাজারের চাহিদা মেটাতে এবং দক্ষ ও প্রজ্ঞ কর্মচারী গঠনে এই পরিবর্তন অপরিহার্য। প্রশ্নফাঁস রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। পরীক্ষার সাথে প্রার্থীদের শিক্ষাজীবনের ফলাফল যুক্ত করে মেরিট লিস্ট তৈরি করা এবং তাদের সামগ্রিক পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা উচিত। 

ভবিষ্যতের জন্য সুপারিশ হলো, পরীক্ষার পদ্ধতিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় একজন প্রার্থীকে এই সমস্ত দিক থেকে মূল্যায়ন করলে যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী বাছাই করা সহজ হবে। বহুমুখী পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়ন, দক্ষতা পরীক্ষা, পোর্টফোলিও মূল্যায়ন, অনলাইন মূল্যায়ন, এবং স্বচ্ছ মূল্যায়ন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে প্রার্থীদের প্রকৃত যোগ্যতা ও মেধা মূল্যায়ন করা সম্ভব।

এতে প্রশাসনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী ও কার্যকর হবে। পরিশেষে পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি মেরিট পুল তৈরি করে রাখতে পারে যাতে করে চাহিবা মাত্রই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দক্ষ ও মেধাবীদেরকে চাকরির জন্য সুপারিশ করতে পারে এতে শ্রম, সময় এবং খরচ সাশ্রয় হবে। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence