রাইসির মৃত্যু কি মোড় ঘুরিয়ে দেবে ইরানি সিনেমার?

ইরানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি ও কয়েকটি নামকরা ইরানি ছবির পোস্টারের কোলাজ
ইরানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি ও কয়েকটি নামকরা ইরানি ছবির পোস্টারের কোলাজ   © সম্পাদিত

একটা সময় ছিল যখন বিশ্ব চলচ্চিত্রে এশিয়ান সিনেমার উপস্থিতি বলতে মোটা দাগে ধরা হতো জাপানি এবং ইন্ডিয়ান সিনেমা। আকিরা কুরসাওয়া কিংবা সত্যজিৎ রায়ের মতো ফিল্মমেকাররা সেটার নেতৃত্ব দিতেন। এরপর দেশে দেশে সময়ের সাথে আঁকাবাঁকা পথে বেকে গেছে চলচ্চিত্রের গতিপথ। বিশ্ব সিনেমায় জাপান তার প্রভাব অনেকটা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলেও একেবারে খেই হারিয়েছে ইন্ডিয়ান সিনেমা। আর এরই মধ্যে এশিয়ার দুটি দেশের সিনেমা বেশ মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে। দেশ দুটি হলো দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরান। ইরানি চলচ্চিত্র খুঁজে পেয়েছে তার নিজস্ব ভাষা ও নান্দনিকতা। 

গত তিন দশক ধরে বার্লিন,ভেনিস বা কানের মতো প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব গুলোতে দাপটের সাথে চিহ্ন রেখে আসছে ইরানি সিনেমা। কিন্তু সেইসব বাঘা নির্মাতাদের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখি অধিকাংশ নির্মাতাই কট্টরপন্থী ইরান সরকার দ্বারা জেইল জুলুমের শিকার।সর্বশেষ যদি মোহাম্মদ রোউসুলফের কথা বলি তাহলে দেখি আট বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়েছেন তিনি। কারাদণ্ডের সঙ্গে তাঁকে চাবুক মারা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এবারের কান উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগ অর্থাৎ পাম দো’র পুরষ্কারের মনোনয়ন পেয়েছে তাঁর সিনেমা ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’। ছবিটি কান উৎসব থেকে প্রত্যাহার চেয়েছিল রাইসির ইরান সরকার। কিন্তু সেটি করতে রাজি হননি নির্মাতা। এরপর ওঁকে জেল এবং চাবুক মারার আদেশ দেন আদালত। এর আগে ২০২০ সালে ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’ সিনেমার জন্য বার্লিন উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন বিয়ার’(স্বর্ণভালুক) জেতেন রোউসুলফ। তখনও ওঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে ইরানে বিক্ষোভ শুরু হলে মুক্তি দেওয়া হয়। তাহলে কী আছে রোউসুলফের সিনেমায় যেটার কারনে প্রয়াত রাইসির সরকার বারবার প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন? ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ এখনও মুক্তি না পেলেও উইকিপিডিয়ার তথ্যে যেটুকু জানা গেছে তা হলো তেহরানের বিপ্লবী আদালতের একজন তদন্তকারী বিচারক ইমানকে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়েছে যিনি দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিবাদ তীব্র হওয়ার সাথে সাথে ইরান সরকারের কঠোরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং হয়তো শেষমেশ হেরে যান। এর আগে ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’এ আমরা দেখি রোউসুলফ তার সিনেমায় ইরানের ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের তীব্র সমালোচনা করেন এবং পরে ছবিটি ওই বছর বার্লিন জয় করে। 

শুধু রোউসুলফই না ইরানের আরেক মায়েস্ত্রো জাফর পানাহির কথাও যদি ধরি তাহলে দেখি উনার প্রত্যেকটা ছবি ইরানের বর্তমান বাস্তবতার তীব্র সমালোচনা করে এসেছে এবং প্রায় সবগুলো ছবিই বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উৎসব গুলোতে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেয়েছে। তার মধ্যে ‘ট্যাক্সি’ বার্লিনে,‘ক্রিমসন গোল্ড’ কানে,‘দ্যা সার্কেল’ ভেনিসে এবং ‘দ্যা মিরর’ লোকার্ণতে সেরা ছবির পুরস্কার পেয়েছে। রোউসুলফের মতো জাফর পানাহিও একাধিকবার ইরান সরকার কর্তৃক কারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তার মানে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ইরান সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই সেই সিনেমা গুলো ধারাবাহিক ভাবে পশ্চিমের দাপুটে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল গুলোতে পুরস্কৃত হয়ে আসছে। এমনকি বাংলাদেশের সিনেমা ‘রেহানা মরিয়ম নুর’ যে বছর কানের আ সার্তে রিগা বিভাবে নির্বাচিত হয় সেই বছর ওই বিভাগে পুরস্কার পায় একটি রাশিয়ান সিনেমা যেটিতে দেখা যায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার সোশ্যাল মিডিয়া পেজে সরকার বিরোধী একটি পোস্ট দেয় এবং পরে সেটি নিয়ে দেশে উত্তেজনা তৈরি হয়। এটা থেকে বুঝতে বাকি থাকেনা যে রাশিয়ান সিনেমাটির ওই সরকার বিরোধী পোস্টটি প্রেসিডেন্ট পুতিনের দিকে আঙ্গুল তোলে। 

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ইউরোপের বড় চলচ্চিত্র উৎসব গুলোতে ইরানি সিনেমাকে এতো পুরস্কার দেবার পেছনে রয়েছে বৃহৎ রাজনৈতিক কারণ। ইরান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু তৈরি করলে সেটি সবসময় পুরস্কৃত হয়ে এসেছে। তাই ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর ইরান যদি অস্থির হয়ে ওঠে আর রাজনৈতিক পট যদি পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহলে তার প্রভাব অবশ্যই তাদের সিনেমার গল্পের উপর গিয়ে পড়বে। আর তখন পশ্চিমারা ইরানি সিনেমাকে পুরস্কৃত করার আগে হয়তো আবার নতুন করে ভাববেন। 

লেখক: জিৎ দে, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ডেইলি ক্যাম্পাসের মাল্টিমিডিয়া প্রধান।  


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence