মহানবী (সাঃ) এর মদীনা রাষ্ট্র: অসাম্প্রদায়িক ভাবনা
- লিমা মেহরিন
- প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৫ PM , আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৩ PM
ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে আরব সমাজে বিপ্লবের বার্তাবহরুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, মানবতার মূর্ত প্রতীক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। ধর্মের আলোকে পরিবর্তন এনেছিলেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থায়। সমতা, ঐক্য এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠা ইসলাম একটি মানবতাবাদী ধর্ম। একটি সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। এই ধর্ম যেমন আধ্যাত্মিক তেমন রাজনৈতিকও। এখানে ধর্মীয় জীবনের পাশাপাশি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ সকল বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং ঐশী প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়ে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার জগৎ ছাড়িয়ে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ঐতিহাসিক Philip K. Hitti তাঁর History of The Arabs গ্রন্থে এ ঘটনাকে তাঁর জীবনের “Turning Point” এবং বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, সমাজ সংস্কারক ও ঐতিহাসিক Syed Amir Ali একে মদীনাবাসীর জন্য ‘New era’ বলে অবিহিত করেন। মদীনায় হিজরত মহানবী (সা.) কে ধর্ম প্রণেতার পাশাপাশি একজন মহান সমাজ সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, রাজনীতিজ্ঞ, সমরনায়ক, বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মদীনায় ইসলামী অনুশাসনভিত্তিক মদীনা রাষ্ট্র গঠন করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই মদীনা রাষ্ট্র ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে মহানবী (সা.) মদীনা রাষ্ট্রকে ওহী লিখন বিভাগ, যাকাত ও সাদাকাহ বিভাগ, যোগসূত্র স্থাপন বিভাগ, চিঠিপত্র বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ এবং রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিগত বিভাগ ইত্যাদি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করেন । এই সব বিভাগে দায়িত্ব পালনের জন্য সৎ, দক্ষ এবং যোগ্য সচিব নিয়োগ করেন। মহানবী (সা.) স্বয়ং প্রধান বিচারক ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন এবং ধর্মীয় প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। প্রশাসনিক সুবিধার্থে আরব দেশকে নবীজি (সা.) কতগুলো প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক প্রদেশে একজন ওয়ালি বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করার জন্য অর্থ ও রাজস্ব প্রশাসনকে সুসংহত করে মহানবী (সা.) ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থা কায়েম করেন। তিনি কুসিদপ্রথা উচ্ছেদ করে আরবের ধনবাদী ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলে আঘাত হেনে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
মহানবী (সা.) ধর্মীয় নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মদীনাবাসীদের সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন যা ইতিহাসে মদীনা সনদ নামে পরিচিত। ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি মহাসনদ। এটিই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান বা শাসনতন্ত্র। এর মাধ্যমেই মুসলিমদের সাথে একটি সুসম্পর্কের আবর্তে যুক্ত হয়েছিল ইয়াসরিববাসী। মদিনা রাষ্ট্রকে কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও সমালোচক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মতামতের পক্ষে সুস্পষ্ট ভিত্তি হিসেবে মদীনা সনদের ৪৭ টি (William Montgomary Watt, Muhammad at Medina, p.-241-43) মতান্তরে ৫৩ টি ( ইবনে হিশাম, সিরাতুল নবী (সা.), পৃঃ২৬২-২৭১, দ্বিতীয় খণ্ড) ধারা হতে বিভিন্ন ধারাকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। অনেক ঐতিহাসিক, গবেষক এবং ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেন মদীনারাষ্ট্র ছিল ধর্মভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র । তারা একে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মানতে নারাজ। সেখানেও তারা তাদের স্বপক্ষে এ সনদ থেকে নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন। একটি ইসলামী রাষ্ট্র যে সকল বৈশিষ্ট্য পরিগ্রহ করে তার সবই মদীনা রাষ্ট্রে বিদ্যমান ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাদের হাতে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি । এখানে আল্লাহর আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং আল্লাহই একমাত্র ন্যায় বিচারক।
এছাড়া ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ, আইনের সমতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, অমুসলিম প্রজাদের প্রতি সদয় সংরক্ষণনীতি যথাযথভাবে সম্পাদন এবং জনকল্যাণকামী শাসক এবং শাসনব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেগুলো মদীনা রাষ্ট্রে সুচারুরূপে বিদ্যমান ছিল। তবে মদীনা রাষ্ট্র নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মভিত্তিক এই দুইয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক বিতর্ক থাকলেও মহানবীর (সা.) এর মদীনা রাষ্ট্র যে পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক এবং পরমতসহিষ্ণুতার এক উৎকৃষ্ট ও সৌন্দর্যময় উদাহরণ তাতে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। “পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যসব রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির মাধ্যমে মহাগ্রন্থ আল কোরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে স্বীয় প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি বলে মদীনার মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে পয়গম্বর মুহাম্মদ (সা.) যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেন, তা পৃথিবীর রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং থাকবে।“(ড. আবদুল বাছির, মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তার রূপরেখা)।
মদীনা রাষ্ট্র সহনশীল ও অসাম্প্রদায়িক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মহানবী (সা.) একজন ধর্ম প্রচারক হয়েও মদীনা রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নাগরিককে ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতিতে সম অধিকার প্রদান করেন। পবিত্র কুরআনেও ঘোষিত হয়েছে, “ধর্মের জন্য কোনো বাড়াবাড়ি নাই”, “….তোমাদের জন্য তোমাদের দীন, আর আমার জন্য আমার দীন।…“( সূরা কা-ফিরূন, আয়াত-৬) মহানবী (সা.) অমুসলমান নাগরিকদের জিম্মির মর্যাদা দান করেন এবং তাদের জীবন, সম্পদ ও ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি তাদের স্ব স্ব ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দান করেন এবং স্ব স্ব সংস্কৃতির সেবার অবাধ অধিকার প্রদান করেন। (শেখ মুহাম্মদ লুৎফর রহমান; ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজ, মদীনা রাষ্ট্র ও তার প্রশাসনিক কাঠামো, পৃঃ ৩৮)। মহানবী (সা.) কোনো গোষ্ঠীর উপর জোরপূর্বক ধর্মকে চাপিয়ে দেননি এবং কোনো ধর্মের উপাসনালয়ও ধ্বংস করেন নি। মদীনা সনদের ১৬ (৬) ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ইহুদি যদি আমাদের অনুসরণ করে তবে সে সমান সুযোগ ও সহানুভূতি পাবে যতদিন পর্যন্ত সে কোনো মুসলিমের ক্ষতি সাধন না করে।“
এখানে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইবনে হিশামের শিরা গ্রন্থ অনুসারে মদীনা সনদের ১৪ ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘কোন মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করবে না বা কোন অমুসলমানকে কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে সাহায্য দান করবে না।“ এ ধারাতে মদীনার নাগরিকদের মুসলিম এবং অমুসলিম এ দু’ভাগে বিভাজন করা হলেও এ রাষ্ট্রে মুসলিমদের সাথে সাথে ইহুদি ও খ্রিষ্টান সকলে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। ধারা ২৫-এ উল্লিখিত হয়েছে- ‘বানু আউফের ইহুদিগণ মুসলমানদের সাথে এক সম্প্রদায়। ইহুদিরা তাদের ধর্ম পালন করবে আর মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পালন করবে। এই বিধান তাদের মাওয়ালীদের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। তবে যে অন্যায় করবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবে তার ফল কেবল তার উপর এবং তার পরিবারের উপর পড়বে।“
এই ধারার পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়-ইসলামের মহান উদারতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং ধর্ম পালনে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বাহরাইনের শাসক মুনজিরকে মহানবী (সা.) যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে ম্যাজিয়ান এবং খ্রিস্টানদের সমান সুযোগদানের কথা বলেন, এমনকি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও তাকে শাসকের পদ থেকে অপসারণ করা হবে না বলেও জানান। যা ছিল মহানবী (সা.)’র অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং সহনশীলতার চরম বহিঃপ্রকাশ। হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)। Syed Amir Ali তাঁর A Short History of the Saracens (অনুবাদঃ আরব জাতির ইতিহাস;শেখ রেয়াজুদ্দীন আহম্মদ) গ্রন্থে উল্লেখ করেন- “হিজরি ষষ্ঠ বছরে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সিনাই পাহাড়ের নিকটস্থ সেন্ট ক্যাথারিন নামক মঠের সন্ন্যাসীদিগকে এবং অন্যান্য সব খ্রিষ্টানকে এক সনদ প্রদান করেন। অসাধারণ সহিষ্ণুতার কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ ইহা জগতে এখনো দেদীপ্যমান রহিয়াছে। ইহা দ্বারা তিনি খ্রিস্টানদেরকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও স্বাধীনতা প্রদান করেন।”
এই সনদের কোন শর্ত ভঙ্গ না করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আদেশ জারি করেন। খ্রিস্টানদের নিরাপত্তাদান এবং তাদের গির্জা ও বাসস্থান হিফাজতে নবী (সা.) নিজে প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাঁর শিষ্যমন্ডলীকেও অনুরূপ আদেশ দেন। খ্রিস্টানদের নিকট থেকে কোন অতিরিক্ত কর আদায় করা হয়নি। তাদেরকে স্বধর্ম ত্যাগে কোনরূপ বাধ্য করা হয়নি। কোন মঠাধ্যক্ষকে মঠ থেকে বিতাড়িত করা হয়নি। তীর্থযাত্রায় বাধা দেওয়া হয়নি। উপরন্তু সনদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের মঠ বা গির্জা সংস্কার অথবা অন্য কোন ধর্মকার্যে মুসলমানদের সাহায্যপ্রার্থী হলে মুসলমানরা তাদের সাহায্য করবে।
প্রকৃতপক্ষে সবই ছিল ইসলামের সুমহান আদর্শের বাস্তবায়ন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের নিরলস প্রয়াস। মহানবী (সা.) মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। পরস্পর হিংসা-দ্বেষ ও কলহের অবসান ঘটান। আরবের অজ্ঞতা আর জাহিলিয়াতকে নির্মূল করেন। সর্বোপরি তিনি সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা, অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে উদারতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং অসাম্প্রদায়িক ভাবনায় একটি সর্বোচ্চ কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন করেন।
মূলত শান্তি, সাম্য, ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলাম তথা প্রিয়নবী (সা.) এর মূল আদর্শ। কীভাবে বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন করা যায় তার উত্তম দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়েছেন শতধা বিভক্ত বর্বর আরব জাতিকে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে এক অনুপম আদর্শভিত্তিক মদীনা রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে।
লেখকঃ কবি ও কথাসাহিত্যিক এবং সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল