আরবি হরফে বাংলা লেখা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিলো যেভাবে

ভাষা আন্দোলন
ভাষা আন্দোলন  © সংগৃহীত

বাংলাদেশে আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিটি তৈরি হয়েছিল বেশ আগে থেকেই। উনিশশ' সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই দেশটির রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেবার তৎপরতা শুরু হয়। এর পাশাপাশি আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনাও চালু করা হয়েছিল।

পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আগাগোড়াই বাংলা ভাষা বিরোধী মনোভাব ছিল। বাংলাদেশি ইতিহাসবিদদের মতে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এর অংশ হিসেবে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়, যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমান ছিলেন এ চিন্তার প্রবর্তক। তিনি যুক্তি তুলে ধরেন যে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তানের সব ভাষার অক্ষর এক হওয়া উচিত বলে তিনি প্রচার করতে থাকেন। তার যুক্তি ছিল, পশতু, সিন্ধী এবং পাঞ্জাবী ভাষার হরফ আরবির মতো। সুতরাং বাংলার হরফও সে রকম হতে পারে।

ইতিহাসবিদ ও ভাষা সংগ্রামী বদরুদ্দীন উমর সেসব ঘটনা খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তার মতে, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হলেও আরবি হরফ প্রবর্তনের এই ষড়যন্ত্র ভালভাবে দানা বাঁধে ১৯৪৯ সালে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে করাচীতে পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সে সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন, বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রচলন করতে হবে। এর পক্ষে তিনি নানা যুক্তি তুলে ধরেন। বিষয়টি নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা এবং প্রচারণা চলতে থাকে।

এক পর্যায়ে বাংলায় আরবি হরফ প্রবর্তনের বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বলে মত দেন সৈয়দ আলী আহসান। এরপর শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান, শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসানকে দিয়ে একটি চিঠি পাঠান ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে। বদরুদ্দীন উমর তার 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' বইতে সে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- প্রমিত ভাষা ব্যবহার জরুরি: ঢাবি উপাচার্য

বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, "সেই চিঠিতে মাহমুদ হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে লেখেন যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর প্রবর্তন করতে চান। এবং এজন্য তার সাহায্য পেলে উপকৃত হবেন।" ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সে চিঠির কোন জবাব দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। উল্টো তিনি এই চিঠির বিষয়বস্তু সংবাদপত্রে জানিয়ে দেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সেটি প্রকাশ করে।

বিষয়টি নিয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাকে তিরস্কারও করা হয় পরবর্তীতে। "এর কিছুকাল পরে ১৯৪৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকাতে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর তাদের সম্মানার্থে নিজের বাসভবনে একটি চা-চক্রের আয়োজন করেন। মাহমুদ হাসান এবং ডক্টর শহীদুল্লাহ উভয়েই সেখানে উপস্থিত ছিলেন," লিখেছেন বদরুদ্দীন উমর।

"আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করে হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে বলেন যে তিনি আসলে দেশদ্রোহী। তা না হলে সরকার থেকে তার কাছে একটা জরুরি ব্যাপারে পত্র দিলে যথাস্থানে তার উত্তর না দিয়ে প্রেসের কাছে, বিশেষত: বিদেশী প্রেসের কাছে তিনি কখনোই তার বিবরণ প্রকাশ করতে পারতেন না।"

এরপর ১৯৪৯ সালে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের এক সভায় মন্ত্রী ফজলুর রহমান আবারে একই যুক্তি তুলেন। তার যুক্তি ছিল, বাংলায় অনেক যুক্ত বর্ণ থাকায় সেগুলো টাইপ রাইটিং এবং শর্ট-হ্যান্ডে ব্যবহার করা যায় না। মন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন, "দ্রুত লেখন এবং পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলিয়া আরবীকেই পাকিস্তানের হরফ করা উচিত। আমাদের দেশবাসীর শতকরা মাত্র ১০ ভাগ লেখাপড়া জানে এবং অবশিষ্ট ৯০ ভাগ লিখিত বা পড়িতে পারে না। হরফ আরবীই হউক বা আর যাহা হউক তাহাতে তাদের কিছু যায় আসে না।"

আরও পড়ুন- ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরবিকে সহজ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সহজ হরফ প্রবর্তিত হলে নিরক্ষরতা দূর করার পথ সুগম হবে। আরবি হরফে বাংলা চালুর জন্য পাকিস্তান সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার বিরুদ্ধে ধীরে-ধীরে প্রতিবাদ গড়ে উঠতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাবিদ এবং ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। আরবি হরফ প্রবর্তনের নিন্দা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে একটি চিঠি দেয়।

বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষার্থীরা যুক্তি তুলে ধরেন যে আরবি হরফ চালু হলে পূর্ব-পাকিস্তানে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ একজন নতুন শিক্ষার্থীর জন্য আরবির চেয়ে বাংলা অক্ষর শেখা বেশি সহজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও জগন্নাথ কলেজ এবং ইডেন কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আরবি হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সচেতন মহলে এই প্রতিবাদ জোরালো হয়।

এমন প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলা সরকার একটি প্রেসনোট জারি করে বলতে বাধ্য হয় যে বাংলা ভাষা বাংলা হরফে লেখা হবে, না আরবি হরফে লেখা হবে সেটি পূর্ব বাংলার জনসাধারণ নির্ধারণ করবে। আরবি হরফ চালুর উদ্যোগকে সরকারের দিক থেকে গুজব বলেও বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এরপরেও আরবি হরফ চালুর উদ্যোগ থেমে থাকেনি। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে বেশ কিছু কেন্দ্র খোলা হয় যেখানে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেবার কাজ শুরু হয়। এ খাতে সরকার বাজেটও বরাদ্দ করেছিল। সরকারের এই বরাদ্দকে অপচয় হিসেবে বর্ণনা করেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

কিন্তু পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান তার পরিকল্পনা নিয়ে অনড় থাকে। আরবি হরফে বাংলা লেখা চালুর জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আরবি হরফে বাংলা লেখা চালু এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা একই সাথে শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে মত দেন।

আরও পড়ুন- ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় যা ছাপানো হয়েছিলো?

কিন্তু এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। এর শিরোনাম ছিল - পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন, "পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন। যেমন - পষতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা; কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষারূপে চালু নয়।"

কেউ কেউ উর্দুর সাথে ইসলামের একটি সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অনেক শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীরা বিষয়টি মানেননি। তারা ভাষা এবং ধর্ম - এ দুটোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেছেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ অধিবেশনে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সে প্রস্তাবে তিনি উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে চালু করার দাবি তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেটির চূড়ান্ত সময় আসে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে পুলিশ তাতে গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার ও আবুল বরকত। আহত হয় আরো অনেকে।

পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারিও বিক্ষোভ বের করলে তখনো গুলি চালানো হয়। নিহত হন শফিউর রহমান। রাষ্ট্রভাষার এই আন্দোলন ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তৎকালীন রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের বর্ণনায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা যতগুলো ভুল করেছিল তার মধ্যে এটি ছিল মারাত্মক। স্মৃতিচারণমূলক 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইতে তিনি সে কথা লিখেছেন। "ক্ষমতাসীন দলের অন্যান্য মারাত্মক ভুলের মত এটাও ছিল একটা মারাত্মক ভুল। সম্ভবত: সব চাইতে মারাত্মক ভুল। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের মুখের ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হইবে, এটা বুঝিতে প্রতিভার দরকার হয়না," লিখেছেন আবুল মনসুর আহমদ। ভাষা আন্দোলনের সেই ঘটনা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে চরম অবিশ্বাস তৈরি করেছিল।

সূত্র: বিবিসি বাংলা


সর্বশেষ সংবাদ