মানাতে না পারলে আর লকডাউন নয়: পরামর্শক কমিটি
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২১, ১০:৫৬ PM , আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২১, ১০:৫৬ PM
ঈদ উপলক্ষে ও রপ্তানিমুখী কারখানা খুলে দেয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আর লকডাউনের কার্যকারিতা দেখছেন না করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যেই চালু হয়েছে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা। শনিবার শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার চরম ভোগান্তির পর ১৬ ঘন্টার জন্য লঞ্চ ও বাস চালু হয়। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান।
শনিবারের ঢাকামুখী জনস্রোত অব্যাহত ছিল রোববারও। কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের ফলে আগের দিন শ্রমিকরা হেঁটে, ভ্যানে ও রিকশায় করে এসেছেন। শ্রমিকদের এই দুর্ভোগের পর তাদের ফেরার জন্য রোববার গণপরিবহণ চালুর ঘোষণা দেয় সরকার। সেই সুযোগে লঞ্চ, বাস ও সিটি সার্ভিস চালু হওয়ায় লকডাউনের কড়াকড়ি উঠে যায়। পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কর্শরত হলেও মোবাইল ফোন অপারেটরদের হিসেবে কোরবানির ঈদে ঢাকার বাইরে গেছেন এক কোটি চার লাখ মানুষ। তাদের অনেকে লকডাউন শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় এসেছেন গাদাগাদি করে।
বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ বলেন, ‘‘মানুষ তো আসছে। বাস-লঞ্চ বন্ধ থাকলেও আসছে। তাদের তো আর থামানো যাচেছ না। কারাখানা খুললে শ্রমিকরা তো আসবেই। তারা ফেরিতে গাদাগাদি করে আসছেন। রিকশা-ভ্যানে করে আসছেন। স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছু নেই। এর চেয়ে বাস চলাচল অব্যাহত থাকলে ৮০ভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হতো। আর হঠাৎ চালু আর বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে তো হবে না। পরিবহণ শ্রমিকরা তো আর বাসে বসে থাকেন না যে নির্দেশের সাথে সাথেই বাস চালু করে দেয়া যায়। এ কেমন সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারছি না।’’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের লকডাউনের এই লেজেগোবরে অবস্থার জন্য কার্যত ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন। তিনি রোববার বলেন, ‘‘সরকারে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এরকম কথা ছিলো না। ব্যবসায়ীদের অনুরোধে রপ্তানিমুখী শিল্প-কলকারখানা বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত করেছে সরকার। ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আশপাশের শ্রমিকদের নিয়ে প্রথমে কারখানা চালু করবেন। ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেবেন। এতে কেউ চাকরিচ্যুত হবেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বাঁধভাঙা জোয়ারে মতো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে রাজধানীমুখী জনস্রোত। এতে করোনা সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’’
কিন্তু বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দাবী করেন ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য সঠিক নয়। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাউকে লকডাউনের মধ্যে আসতে চাপ দেইনি। যারা এসেছেন তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসেছেন।’’ তিনি জানান, ‘‘রোববার পোশাক কারখানায় ৯০ ভাগের বেশি শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন। বাকিরা লঞ্চ ও বাস চালুর সুযোগে চলে আসবেন আশা করি।’’ যারা ঢাকা আসছেন তাদের সবাই তৈরি পোশাক শ্রমিক না উল্লেখ করে তিনি বলেন সেখানে অন্য খাতের শ্রমিক ও পেশার লোকজনও আছেন।
এদিকে ঈদের বিরতির আগে-পরে দুই দফা লকডাউনেও করোনা সংক্রমণ কমেনি। বরং সংক্রমণের হার সার্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে করোনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৯৭ শতাংশে, যা এ পর্যন্ত গড় হারের প্রায় দুই গুণ। ১ জুলাই প্রথম দফা লকডাউন শুরুর আগের দিন ৩০ জুন এই হার ছিলো ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওইদিন ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ১১৫ জন। এখন দৈনিক মৃত্যু ২০০-এর উপরে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৩১ জন। সারাদেশে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২০ হাজার ৯১৬ জন। এর মধ্যে গত সপ্তাহেই মারা গেছেন এক হাজার ৪৪৪ জন।
এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনের কার্যকারিতা ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ৫ আগস্টের পর লকডাউন আর থাকবে কীনা তা নিশ্চিত নয়। তবে বিধিনিষেধ থাকছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
সার্বিক পরিস্থিতি দেখে লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমত হতাশা প্রকাশ করেছেন করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘‘১ জুলাই থেকে ১৪ দিনের লকডাউনে সংক্রমণ কমে আসছিল। আমরা তখন আরও ১০ দিন লকডাউনের সুপারিশ করেছিলাম।কিন্তু তা না করে ঈদে লকডাউন তুলে দেয়া হলো। ফলে সংক্রমণকে যে আটকানো হয়েছিলো তা আবার খুলে গেল। সংক্রমণ বাড়ল। দ্বিতীয় দফায় এবার পোশাক কর্মীদের গাদাগাদি করে যেভাবে ঢাকা আনা হলো তাতে আর কিছুই থাকলো না। সংক্রমণ এখন আরো বেড়ে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আর লকডাউনের পক্ষে না। এভাবে যদি প্রশাসন লকডাউন না মানাতে পারে তাহলে মনে হয় আর লককডাউন করাটা ঠিক হবে না। তা না করে বিধিনিষেধগুলো মানানো জরুরি। এখানে কোন ছাড় দেয়া যাবে না।’’
তবে এই বিশেষজ্ঞ আরও মনে করেন, এ অবস্থায় অফিস খুললেও বেশিরভাগ মানুষের ঘরে থেকে কাজ করা এবং গণপরিবহণ, দোকান, কলকারখানায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রচুর পরীক্ষা করে তার ভিত্তিতে আইসোলেশন ও কোয়ারান্টিনের বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে। তৃতীয়ত, মাসে এক থেকে দেড় কোটি টিকা দিতে হবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে লকডাউনের প্রয়োজন নেই।
তবে এসব বিষয়ে জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির আরো দুই দিন পর্যবেক্ষেণ করে সরকারকে তাদের মতামত জানাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। চলমান লকডাউন শেষ হবে ৫ আগস্ট। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]