বাংলাদেশে কী করলে ধর্মীয় অবমাননা হয়? শাস্তি কী?

ধর্ম অবমাননার প্রতিবাধে ঢাকায় বিক্ষোভ
ধর্ম অবমাননার প্রতিবাধে ঢাকায় বিক্ষোভ  © সংগৃহীত

ফ্রান্সে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে অনেক দেশে বিক্ষোভ চলছে। বাংলাদেশেও এই নিয়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে ধর্মীয় অবমাননা, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম)-এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১টি দেশের তালিকা উঠে আসে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এই আইনের অধীনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’-এর মতে, ২০১৭ সালে ৭৭টি দেশের আইনে ব্লাসফেমি, ধর্ম অবমাননা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অনুরূপ আচরণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামিক দেশগুলোতে ব্লাসফেমি আইনের অনুশীলন হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তবে এই ধরনের আইন ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক জায়গায়ই কার্যকর রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ধর্মীয় অবমাননা বিষয়ে কি বলা হয়েছে? কী করলে ধর্মীয় অবমাননা হয়? এক্ষেত্রে শাস্তির বিধানই বা কি?

কী করলে ধর্মীয় অবমাননা হবে?

বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কোন ধর্মীয় স্থানের ক্ষতি সাধন, অসম্মান করা, লিখিত বা মৌখিকভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি, অসম্মান করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় স্থানে অনধিকার প্রবেশ বা ধর্মীয় বাক্য বা শব্দের বিকৃতি ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, বাংলাদেশের আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়। সব ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মানুভূতি আহত হলে এই আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন। তবে সাধারণত দেখা যায়, ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীরাই এই আইনের আশ্রয় বেশি নিয়েছেন।

তিনি বলেন, অন্য ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী বাংলাদেশে ধর্মবিশ্বাস আহত হওয়ার অভিযোগে এই আইনের সহায়তা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

আইনজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশের আইনে ধর্মানুভূতি আঘাত করার অভিযোগে মামলা করার বা বিচার প্রক্রিয়ায় শাস্তির উদাহরণ বেশি নেই। কিন্তু ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ বা পিটিয়ে হত্যার ঘটনা অনেকবার ঘটেছে।

বাংলাদেশের আইন ও শাস্তি

বাংলাদেশে যে আইনে ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা হয়, সেই ১৮৬০ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে ধর্মীয় অবমাননার বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে। আইনটি ১৯২৭ সালে সংশোধন করে নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই আইনটি সামান্য পরিবর্তন করে গ্রহণ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশে বা ভারতে ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা বা ধর্ম অবমাননার ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই আইন রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৬০ সালে যে ফৌজদারি দণ্ডবিধি তৈরি করা হয়, সেখানেই এ সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে যদিও সেটি কিছু কিছু সংশোধিত হয়েছে।

তিনি বলেন, এই আইনের ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় ধর্মীয় অবমাননার ব্যাখ্যা ও শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে। যেকোনো ধর্মের মানুষের জন্য তাদের বিশ্বাস আহত হলে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ধর্মীয় স্থান বা সেখানকার কেনা বস্তু ধ্বংস করা, ক্ষতি করা বা অসম্মান করাকে ধর্মীয় অবমাননা হিসাবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে একটি সংশোধনীতে ২৯৫(ক) ধারায় যোগ করা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের কোন নাগরিককে মৌখিক, লিখিতভাবে বা অন্য কোন উপায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

একই আইনের ২৯৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আইনসঙ্গতভাবে আয়োজিত ধর্মীয় কোন সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে কেউ বাধা বা বিশৃঙ্খলার তৈরি করলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তাহলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কোন স্থানে অনধিকার প্রবেশ করা, মৃতদেহের অসম্মান অথবা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সমস্যা তৈরি করা হলে সেটাও ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এরকম অপরাধের ক্ষেত্রে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোন বাক্য বা শব্দ বিকৃত করা, এমন অঙ্গভঙ্গি করা যাতে তার ধর্মবিশ্বাস আহত হতে পারে, এমন আচরণ করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানারও বিধানও রয়েছে।

প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় অবমাননা

২০১৮ সালে বাংলাদেশে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার শাস্তি আরও বাড়ানো হয়েছে। এই আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোন কিছু প্রকাশ, সম্প্রচার, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

এ ধরনের অপরাধ করলে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরণের অপরাধ করেন, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের একটি সম্মেলনের ১৩ দফা দাবির একটি ছিল ব্লাসফেমি আইনের আদলে ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে একটি আইন প্রণয়ন।

তবে সেই দাবি নাকচ করে দিয়ে বিবিসি বাংলাকে ২০১৩ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইনের আদলে কোনো আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা নেই সরকারের। দেশে আইনের অভাব নেই। তথ্য প্রযুক্তি আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ফৌজদারি বিধিতেও বিষয়টাতে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

আদালতে মামলা কে করে?

আইনজীবীরা বলছেন, ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত মনে হলে, ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হলে যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আইনের সহায়তা নিতে পারেন। তিনি যেমন থানায় মামলা করতে পারেন, আবার সরাসরি আদালতেও মামলা করতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিচার ও শাস্তি হতে পারে।

তবে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ -সমাবেশ হলেও আইনের আশ্রয় নেয়ার উদাহরণ খুব কম।

বাকস্বাধীনতা ও ধর্ম অবমাননা

ইউরোপের বেশকিছু দেশেও ব্লাসফেমি আইনে মামলা হওয়ার নজির রয়েছে।

ডেনমার্ক - কোরান পুরানোর একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করায় ২০১৭ সালে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে অভিযোগ আনা হয়।
ফিনল্যান্ড - ইসলাম বিষয়ে একটি ব্লগ পোস্টে অবমাননাকর মন্তব্য করায় ২০০৯ সালে এক ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়।
জার্মানি - ‘কোরান,পবিত্র কোরান’ লেখা টয়লেট পেপার বিলি করায় ২০০৬ সালে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
জার্মানি - গাড়িতে খ্রিস্টান বিরোধী স্টিকার লাগানোর দায়ে ২০১৬ সালে এক ব্যক্তিকে ৫০০ ইউরো জরিমানা করা হয়।
আয়ারল্যান্ড - টিভি অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ কমেডিয়ান স্টিফেন ফ্রাই'য়ের মন্তব্যের কারণে অভিযোগ আনা হলে তদন্ত চলে তাঁর বিরুদ্ধে।


সর্বশেষ সংবাদ