প্রসঙ্গ মহান মে দিবস
একজন নারী শ্রমিকের কষ্টের গল্প
- আবদুর রহমান, নোয়াখালী প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০১ মে ২০২০, ১১:৪৪ AM
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিধ্বস্ত পৃথিবীতে আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৩৩ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গোটা দুনিয়া এখন টালমাটাল। বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। তবে অনেককে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাদের ফিরতে হচ্ছে কল-কারাখানায়। মহান মে দিবস উপলক্ষে তেমনি একজন নারী শ্রমিকের কাহিনী তুলে ধরছি—
রিতা (ছদ্মনাম) নামের এক কারখানার শ্রমিক, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যার জন্ম। বিয়ে হয়েছে একই উপজেলার একজন সিএনজি ড্রাইবারের সাথে। বিয়ের প্রথমদিকে অনেক সুখে জীবন-যাপন করেছে। পরিবারে দুই সন্তানসহ মোট চার সদস্যের একটি সুখী পরিবার ছিল তাদের। বড় মেয়ে তখন ৫ম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে পড়তো ২য় শ্রেণিতে। হঠাৎ একদিন হৃদয় বিদারক এক সংবাদ। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির দুরারোগ্যে দুইটি পা কেটে ফেলতে হয়। যার ফলে সে সারাজীবনের জন্য পুঙ্গ হয়ে যায়। তারপক্ষে আর কখনও কাজ করা সম্ভব নয়।
তার পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে সংসার চালানোর জন্য যতটুকু সাপোর্ট ছিল সেটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। শান্তির অবসান ঘটে তার পরিবারের। এরপর অভাবের কালো ছায়া নেমে আসে তাদের পরিবারে। স্বামীর এই অক্ষমতার কারণে মাঝে মধ্যেই অনাহারে অর্ধহারে দিন কাটাতে হয় স্ত্রীসহ পরিবারের সকল সদস্যকে। এইভাবেই চলছিল দিনের পর দিন। স্বামীর কর্ম অক্ষমতার কারণে ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ চালিয়ে নিতেও অনেক হিমশিম খেতে হয়ছে তার। এরপরও জীবন যুদ্ধে হাল ছাড়েনি রিতা। চোখের সামনে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সেই অক্ষম স্বামী এবং ছোট ছেলে মেয়েদের অনাহারে ও অর্ধহারে দিন কাটানো। তার এই বিপদের সময় সমাজের বৃত্তবানরা যদিও সাময়িক সামান্য সহযোগিতা করেছে কিন্তু তাতে তার তেমন কোন কাজ আসেনি।
এটাই নিয়ম আধাঁর যখন সন্নিকটে তখন নদীর পানিও শুকিয়ে যায়। তাই সে চিন্তা করে যদি সেই তার মেধা এবং শ্রমকে কাজে লাগাতে পারে তাহলে পরিবারের অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও সচল করতে পারবে। কিন্তু কে দিবে? এই অর্ধ শিক্ষিত অনভিজ্ঞ মেয়েটিকে একটি কাজরে সন্ধান ! রিতা লোকে মুখে শুনেছে স্থানীয় একটি বিস্কুট কারখানায় চাকুরী করে গ্রামের অনেক মেয়েই আজ বেশ ভাল আছে। সেই চিন্তা থেকেই এক আত্মীয়র মাধ্যমে স্বামী এবং বাচ্চাদের মুখের একটু হাসি ফোঁটানোর জন্যই বাড়ী থেকে বের হয় এক অনিশ্চিত জীবন যুদ্ধে। আজ সবারই জানা কলকারখানা হলেও অশিক্ষিত এবং অনভিজ্ঞদের কর্মে প্রবেশ বেশ বড়ই কঠিন। তার পরও আল্লাহর বিশেষ রহমতে সে নোয়াখালীর সুনামধন্য গ্লোব বিস্কুট এন্ড ডেইরী মিল্ক কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ পায়। এভাবেই শুরু হল রিতার জীবন যুদ্ধ। মাস গেলে যে বেতন পায় তা নিজের খাওয়া, বাসা ভাড়া দিয়ে বাকি টাকা দিয়ে নিজের জীবন বেশ চলছিল আগের চেয়ে কিছুটা হলেও ভাল।
তারপর হঠাৎ এক ঘোষণা! দেশে করোনা পরিস্থিতি রূপ খুব ভয়াবহ! আর তাই সরকার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কল কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। মাস শেষে বেতন পেয়ে পারিবারিক খাদ্য নিশ্চিত করা রিতা এখন বাসায়। আবারও বন্ধ হয়ে গেল তার অর্থনীতির চাকা। অনির্দিষ্টকালের এই বন্ধে রিতা তার পরিবারের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এই সময় আরও দীর্ঘ হলে তার পরিবারের সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছে রিতা।
এ গল্প রিতার জীবনের, একজন কারখানার শ্রমিকের জীবনের। যে কর্মী দেশের তৈরি প্রোডাক্টকে সমৃদ্ধ করে। দেশকে বৈদেশিক মূদ্রা দেয়। তবু আজও বেঁচে আছে স্বামী এবং ছোট ছেলে মেয়েদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। বেঁচে থাকতে হবে নিজে এবং তার পরিবারে জন্য।
রিতা জানান, বড় মেয়েটির এখন বয়স ১৩ বছর, ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট ছেলেটির ১০ বছর ৫ম শ্রেণিতে পড়ছে। কষ্ট হলেও ছেলেমেয়েদের একটু শিক্ষিত করার প্রত্যয়। মেয়েটিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার চিন্তা রিতার। তবে সেই যে বেতন পায় তা দিয়ে তার স্বপ্ন কি সে আধো পূরণ করতে পারবে? আজ এমন বাস্তবতাময় জীবনের অনেক বড় হিসাবের মুখোমুখি সে।