করোনার ভয়ে ভর্তি নিল না কেউ, স্বাধীনতার মাসে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিন
মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিন

‘শুক্রবার সকাল থেকে বাবার ভীষণ ডায়রিয়া, সঙ্গে জ্বর। ক্রমান্বয়ে অবস্থার অবনতি হলে শনিবার সকাল ৮টায় বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয় আমাদের বাসাবোর বাসা থেকে। তবে জ্বর-ডায়রিয়া শুনে কেউ ভর্তি নিতে চাননি। এক হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ রাখতে রাজি হলেও, চিকিৎসকেরা আসেননি। আরেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে পাঠানোর সময় চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ। এমন অবহেলার মধ্য দিয়েই অনেকগুলো হাসপাতাল ঘুরে রাত ১২টার দিকে অনেক দেনদরবারের পর একটি হাসপাতাল নিল। কিন্তু বাবাকে বাঁচানো গেল না। আমার বাবা একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। কী যে কষ্ট!’ 

কথাগেুলো মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিনের মেয়ের। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ওই নারী জানান, শনিবার ১৬ ঘন্টা যাবত অ্যাম্বেুলেন্সে করে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরেও বাবাকে ভর্তি করাতে পারেনি। পরে রাতে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সেখানে বিপত্তি। হাসপাতালের সিটিস্ক্যান, এমআরআই মেশিন নষ্ট। পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। পরে শুধু স্যালাইন দিয়ে রাখা হয় আলমাছ উদ্দিনকে। বাকি চিকিৎসা  পরীক্ষার পর শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তবে সেই সুযোগ আর হয়নি। সকাল সোয়া ৭টায় মারা যান তিনি।

মৃত্যুর পরে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হলো ব্রেইন স্ট্রোক। পরে গতকাল রোববার বাদ জোহর বাসাবো মাঠে নামাজে জানাজার পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মাদারটেক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

একজন মুক্তিযোদ্ধার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক যুগ্মমহাসচিব সফিকুল বাহার মজুমদার টিপু গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন, কোনো রোগীর ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়া উচিত নয়। বৈশ্বিক এই মহামারি মোকাবিলার পাশাপাশি অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসার বিষয়টিও দেখতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিনের মেয়ে জানান, বাবা আলমাছ উদ্দিনের পেটের পুরোনো রোগ। শুক্রবার ভীষণ ডায়রিয়া, সঙ্গে জ্বর। কিছুক্ষণ পর কথা জড়িয়ে যেতে থাকে তাঁর। তখনই পরিবারের লোকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন। এমনিতে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেন তিনি। জ্বর-ডায়রিয়া শুনে তাঁরা নিতে চাননি। পরদিন শাহবাগের একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। সেখানে বুকের এক্স-রে করে নিউমোনিয়া মতো মনে হচ্ছিল।

করোনাভাইরাসের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দেখে তাঁরা রাখেননি। সেখান থেকে তাঁরা ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন। তাঁদের আইসোলেশন ওয়ার্ড আছে। রোগী ভর্তি করা যাবে এই আশ্বাস পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আলমাছ উদ্দিনকে। কর্তৃপক্ষ রাখতে রাজি হলেও, চিকিৎসকেরা আসেননি। ওই হাসপাতাল থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা। ভর্তি নেয় তারা। কিন্তু জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে পাঠানোর সময় চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। করোনাভাইরাসের ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য না পেলে রোগী রাখবেন না বলে জানান। তাঁরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যান। পৌঁছানোর আগে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করেন। সন্ধ্যার পর আলমাছ উদ্দিনের অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায় কুয়েত মৈত্রীর গেটে। তাঁরা লক্ষণ দেখে বলেন, রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে আইসোলেশনে থাকতে হবে। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা থাকলে বিপদ। এভাবে ছয় হাসপাতালে গিয়েও বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি সন্তানেরা।

এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যখন এভাবে ছুটছেন আলমাছ উদ্দিন, তখন এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসেন। আলমাছ উদ্দিনের মেয়ে বলেন, ‘বাবা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই পরিচয় দিয়ে কখনও কোনো সুবিধা নেওয়া পছন্দ করতেন না। আমরাও তাই কোনো হাসপাতালে গিয়ে এই পরিচয় দিইনি।’ মুগদা জেনারেল হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড আছে। মুক্তিযোদ্ধারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। হাসপাতালের সিটিস্ক্যান, এমআরআই মেশিন নষ্ট। পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। আলমাছ উদ্দিনের মেয়ে বলেন, বাবাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল শুধু। বাকি পরীক্ষার পর চিকিৎসা শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সেই সুযোগ আর হয়নি। সকাল সোয়া ৭টায় মারা যান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ