দেশে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মূলে কি বেকারত্ব?
- শহিদুল ইসলাম সাহেদ
- প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৬ PM , আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৯ PM
চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কালো থাবায় বিপন্ন বাংলাদেশ। সর্বনাশা এই মরণ ছোবলে সমাজ জর্জরিত। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা সর্বত্রই যেন দুর্নীতি। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বলা হয় দেশের ভবিষ্যৎ।
কিন্তু দুর্নীতির করাল গ্রাসে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্রমেই হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। ফলে হুঁ হুঁ করে বাড়ছে বেকারত্বের হার। সম্প্রতি সময়ে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিসহ অপরাধের সংখ্যাটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকায় হঠাৎ করে বেড়েছে অটোরিকশা ও পাঠাও চালকের সংখ্যাও। স্থানীয়দের ভাষ্য, অনেকে পোশাক কারখানায় চাকরি হারিয়ে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দিনের বেলা ট্র্যাফিক সিগন্যাল, যানজটে প্রতিনিয়ত আটকে থাকে বাস।
খোলা জানালা পেয়ে ছিনতাইকারী মোবাইল ফোন অথবা ভ্যানিটিব্যাগ হ্যাঁচকা টান দিয়ে দৌড় দেয়। জনসাধারণের মাঝে মিশে যাওয়ায় ছিনতাইকারী বা চোরকে আর শনাক্ত করা যায় না। দিনের আলোতে এমন ধরনের ছিনতাই হরহামেশাই ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতে গেল ছয় মাসে খুনের ঘটনা আড়াই’শ প্রায়। আর চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি ৭৭২টি। এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাতের আঁধারে রাজধানীতে অপরাধ সবচেয়ে বেশি।
তথ্যমতে, গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বেকার হয়েছেন এসব কারখানায় কর্মরত এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক। এদিকে নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। এমনকি বর্তমানে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি নেই, নেই নতুন পণ্য। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কিছু বন্ধের পথে।
বেকারত্ব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা না থাকাকে অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মধ্যে আস্থাপূর্ণ তেমন কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও নষ্ট করে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার কোনো ভিকটিম থানায় মামলা করতে চাইলে অবশ্যই এ ব্যাপারে মামলা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওসিদের। কেউ যদি ছিনতাইয়ের মামলা নিতে না চায় তাহলে পুলিশ কমিশনার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।
জানা যায়, বাংলাদেশের পাশ করা ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের বেকার যুবসমাজের অর্ধেকের বেশি শিক্ষিত বেকার।
আর এ শিক্ষিত বেকারত্বের অন্যতম কারণ হলো, সব জায়গায় চরম দুর্নীতি। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্বের মাত্রা যেন চরমে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেকারত্বের হার বেশি। এখানে বেকারত্বের পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তথ্যমতে, গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বেকার হয়েছেন এসব কারখানায় কর্মরত এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক। এদিকে নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠছে না। এমনকি বর্তমানে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি নেই, নেই নতুন পণ্য। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আরো কিছু বন্ধের পথে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী কামরুল হাসান বলেন, গাজীপুরে যখন একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছিল, তখনই আমরা বুঝেছিলাম এর প্রভাব পড়বে। এখন প্রতিদিন দোকান থেকে চুরি হচ্ছে, পথচারীরা ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন।
গাজীপুরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামা সুজন বলেন, বেকারত্বের কারণে গাজীপুর থেকে রাজধানীতে অপরাধী প্রবাহ বেড়েছে। তারা উত্তরাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হচ্ছে কারণ এখানে প্রচুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং নগদ অর্থের লেনদেন হয়।
আরও পড়ুন: জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত উপকূল, খাবার কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন ৩০ শতাংশ মানুষ
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, অপরাধ কমাতে হলে বেকারদের আয়ের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা না হলে অপরাধ দিন দিন আরো বাড়বে।
দেশে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার ৪.৫৯ শতাংশে পৌঁছেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪.০৭ শতাংশ।
এ সময়ে বেকারের সংখ্যা ১.৭ লাখ বেড়ে মোট ২৬.৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। পুরুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৮১ শতাংশ। যা আগের বছরের ৩.৪৬ শতাংশ থেকে বেড়েছে। নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭.১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। যা আগের বছরের ৬.১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে- দেশে এখনও স্নাতক ডিগ্রিধারীদের প্রতি তিনজনের একজন বেকার। এতে বলা হয়, দেশে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বেড়েছে বেকারের সংখ্যা।
গত এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার। তাদের বেশিরভাগই আবার উচ্চশিক্ষিত। যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাচ্ছে না মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের চিত্র ভয়াবহ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুব বেকারদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক।