নারীদের খেলার বিষয়ে আর নাক গলাবে না, ক্ষমা চেয়ে বললো ভাঙচুরকারীরা
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১১ PM , আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১১:০৯ AM
জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধে টিনের বেড়া ভাঙচুরের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও ও থানার ওসি ঘটনাস্থলে পরিদর্শনের পর ওই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিপুল কুমারকে আহ্বায়ক করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ওসি, জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা ও ছাত্রদের মধ্যে মাহফুজ আহমেদকে সদস্য করা হয়।
আজ শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) সকালে ওই মাঠে ইউএনও এবং ওসিসহ সেনাবাহিনীর একটি দল খেলার মাঠে উপস্থিত হন। সেখানে খেলা বন্ধ করতে মাঠ ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের মধ্য কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। তাদের দাবি, এখানে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে গত মঙ্গলবারে ওই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন তারা। এই মাঠে নারীদের ফুটবল খেলতে আর কোনো বাধা নেই।
সরেজমিনে আজ বেলা ১১টায় তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠের মধ্য কয়েকটি ডেকোরেটারের চেয়ার-টেবিল পড়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম, থানার পরিদর্শক (ওসি) আনিছুর রহমান ও ছাত্র প্রতিনিধি মাহফুজ হোসেন। এ সময় গত মঙ্গলবারে খেলার মাঠে ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে ওই মাঠে দেখা যায়।
এ সময় টি স্টার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক খাজা হোসেনকে উত্তেজিত হয়ে বলতে দেখা যায়, ‘গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রশাসন তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে স্বাক্ষর নিয়েছে, সেটির ব্রিফ হবে।’ এ সময় তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন।
খাজা হোসেন আরও বলেন, ‘ইউএনও স্যার এখানে বারবার আসবে, কেউ এখানে মিথ্যা কথা বলে বাহাদুর সাজতে চাইবে—তা হতে দেব না। এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম, এখন সব কথা জানাব।’
এদিকে তিলকপুরের নারী ফুটবল ম্যাচের মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুর ও খেলা বন্ধের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার নিন্দা জানিয়ে জেলা প্রশাসনকে নারী ফুটবল ম্যাচটি চালুর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) আফরোজা আকতার চৌধুরী ও পুলিশ সুপার (এসপি) মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম, থানার পরিদর্শক (ওসি) আনিছুর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে খেলার মাঠ পরিদর্শন করেন। তারা আশপাশের লোকজন, আয়োজক কমিটি, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও বাদশা হাজী কওমী মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন।
স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিলকপুরের টি স্টার ক্লাবের উদ্যোগে তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে প্রায় দেড় মাস আগে থেকে আন্তঃজেলা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। ওই ক্লাবের সভাপতি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হাসান ইমন। টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচে মাটিতে বসে খেলা দেখার জন্য ৩০ টাকা ও চেয়ার বসে খেলা দেখার জন্য ৭০ টাকা মূল্যের টিকিটের ব্যবস্থা রাখা হয়। টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে পার্বতীপুর ও জয়পুরহাট ফুটবল দল।
ফাইনাল ম্যাচের আগে আয়োজক কমিটি ওই মাঠে একই মূল্যের (৩০ ও ৭০ টাকা) টিকিটে জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের প্রীতি ম্যাচের ঘোষণা দিয়ে এলাকায় মাইকিং করে। তখন থেকেই স্থানীয় আলেম সমাজ বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা শুরু করে। একপর্যায়ে গত মঙ্গলবার বিকেলে একদল মুসল্লি ও মাদ্রাসার ছাত্ররা হামলা চালিয়ে খেলার মাঠে টিনের বেড়া ভাঙচুর করেন। ঘটনাটি আবার হামলাকারীদের মধ্য থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভ প্রচার করা হয়। ওই ঘটনার পর আয়োজকেরা গত বুধবার বিকেলের প্রীতি নারী ফুটবল ম্যাচটি বাতিল করেন।
জানতে চাইলে বাদশা হাজি মাদ্রাসার নায়েবে মোহতামিমের পক্ষে বক্তব্য দেন মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষক মোস্তাকিম হোসাইন। তিনি বলেন, ‘গত মঙ্গলবারে তিলকপুরে নারী ফুটবল খেলা নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে, আমরা তার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাদের মধ্য সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে যা হয়েছে, তাতে আমরা দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে লজ্জিত। আমরা ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করব না। যেখানে সরকার খেলাকে বৈধতা দিয়েছে, সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে আর কখনো যাব না। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আমরা। যা করেছি, এখান থেকে আমরা লজ্জিত। ভবিষ্যতে জয়পুরহাট জেলাতে আর কখনো এই ধরনের কাজ হবে না। আমরা নারীদের খেলার বিষয়ে আর নাক গলাব না।’
ভ্যাটকুরি মসজিদের খতিব ও তিলকপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গত মঙ্গলবারে তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, আমরা আইনকে শ্রদ্ধা জানাই। সরকারি নিয়ম-নীতিতে খেলা হোক, এটা আমরাও চাই। আলেম-ওলামাদের মধ্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই বিষয়টি ঘটেছে। সামনের দিনে আর যেন না ঘটে, আমিও সেটিই চাচ্ছি। সরকারের বিরুদ্ধে আমরা যেতে চাই না।’
টি স্টার ক্লাবের সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হাসান ইমন বলেন, ‘তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝির বিষয়। আমরা আলেম সমাজের সঙ্গে একত্র হয়ে বিষয়টি মীমাংসা করেছি।’
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বলেন, ‘আমরা সবকিছু মিলিয়ে সমাধানের পথে চলে এসেছি। এখানকার জনগণ সবাই একতাবদ্ধ হয়েছেন। এখানে খেলা পরিচালনা করার জন্য আর কোনো বাধা নেই। খুব দ্রুতই আমরা খেলা পরিচালনা করতে পারব।’
আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে তিলকপুর মাঠে নারী ফুটবল খেলাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সেটির প্রায় সমাধান হয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।’
এর আগে, তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার বিকেলে ওই মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুরের ঘটনার খেলা বন্ধ রাখেন আয়োজকেরা।