অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস, কী কী পরিবর্তন এলো?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস  © ফাইল ছবি

আজ থেকে এক মাস আগে গত ৮ আগস্ট রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের কাছে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। ওইদিন প্রধান উপদেষ্টা ও ১৩ জন উপদেষ্টা শপথ নেন। 

পরবর্তীতে আরও তিন দফায় ৭ জন উপদেষ্টা শপথ নিয়ে, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১। উপদেষ্টাদের মধ্যে দুজন তরুণ নজর কেড়েছেন সবার দৃষ্টি। তারা দুজনই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের মধ্যে একজন তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। আরেকজন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। 

in1

এক মাস পূর্ণ হওয়ার আগে অর্থাৎ গত বুধবার ৯২ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৯৮ জন বিশ্বনেতা সমর্থন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। প্রধান উপদেষ্টা তার সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে জাতিকে জানানোর জন্য এক ভাষণ দেন। যার মধ্য দিয়ে জাতি এক নতুন আলোর পথ খুঁজে পায়। তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতি দেন, যা নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য পাথেয়।

এরপর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু। প্রধান উপদেষ্টা রংপুরের শহিদ আবু সাইদের কবর জিয়ারত করে অনেকটা নতুন করে শপথ নেন। দৃঢ়চেতা কণ্ঠে বলেন, শহিদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।

প্রধান উপদেষ্টা এই এক মাসের মধ্যে সব সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি তার বার্তা দিয়েছেন-সর্বত্র সংস্কার করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলে অন্তর্বর্তী সরকার পিছপা হয়নি। যে কারণে এক দিনে রাষ্ট্রদূতসহ ২৪ কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। আবার সর্বত্র পদত্যাগের হিড়িকও ছিল এই এক মাসে।

প্রশাসনিক পদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব এবং পররাষ্ট্র সচিবসহ অনেককে অবসর বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিবর্তন করা হয়েছে। 

সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা গেছে। অনেক কর্মকর্তা বিক্ষোভ ও চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

বিচার বিভাগেও পরিবর্তন ঘটেছে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। নতুন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রতিস্থাপন করে নতুন আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং নির্বাচন কমিশনও পদত্যাগ করেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম-অপসংস্কৃতি চালু হয়েছিল। দ্বিতীয়বারের মতো দেশ স্বাধীন হওয়ার সুবাদে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহহিল আমান আযমী। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডি এক সংগঠক মাইকেল চাকমা মুক্তি পান। আরও মুক্তি পান মীর কাশেমের ছেলে আহমেদ বিন কাশেম আরমান। এই এক মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে।

রংপুরে আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করলেন ড. ইউনূস

রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এক দুর্নীতির মামলায় কয়েক বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে এই মামলা থেকে খালাস দেন। মুক্ত খালেদা জিয়া সাত বছর পর ব্রিটিশ হাইকমিশনের সঙ্গে বৈঠক করার সুযোগ পান। সুইডেন আসলাম দীর্ঘদিন পর জামিন পেলেন। এই এক মাসের মধ্যে নিবন্ধন পেল তিনটি রাজনৈতিক দল। এই এক মাসের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাফল্য অর্জন করেছে। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীরদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, মেট্রোরেল নতুনভাবে আবার চালু করা, ডলারের অস্থিরতা দূর করা, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে টেস্ট জয়ীদের অভিনন্দন দেওয়ার সুযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসকদের শার্টডাউন থেকে মুক্ত করা, গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা দূর করা, বেশ কয়েকটি পণ্যের শুল্ক কমানো, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের আংশিক তালিকা তৈরি করা।

২১ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। এদিন বিসিবি সভাপতির পদ ছাড়েন সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হাসান। একই দিনে বিসিবির সভাপতি হন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হয়েছে, যেখানে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে এবং অন্যান্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে কিছুটা প্রত্যাশা রয়েছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, জনগণের সহযোগিতা ও ধৈর্য প্রয়োজন, এবং সরকারের তরফ থেকে বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: আজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময়

এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন আজ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের শাপলা হলে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে।

এর আগে গত ১২ আগস্ট রংপুরের আবু সাঈদের বাড়িতে যান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন।


সর্বশেষ সংবাদ