সপরিবারে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন এস আলম, সহযোগিতা করেছে আওয়ামী সরকার

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম  © ফাইল ছবি

বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমসহ তার পরিবারের সদস্যরা। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রত্যাহার করেন তারা। একই দিন বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের (পারমানেন্ট রেসিডেন্সিয়াল) অনুমোদন পায় পরিবারটি। এস আলম ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছেন- তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তিন ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির। 

কালবেলা পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে এ সুবিধা দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ ও স্থায়ী আবাসিক সুবিধা গ্রহণ জটিল প্রক্রিয়া হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে একই দিনে এ কাজ করা হয়। অতি গোপনে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজটি করা হয়েছিল।

আবেদনপত্র অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর এস আলম ও তার স্ত্রী এবং তিন ছেলে বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক সুবিধা গ্রহণ করেন। দেশের কোনো নাগরিকের এ সুবিধার প্রয়োজন নেই। নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন বলেই তারা এ সুবিধা নেন। গ্রুপটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। তবে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেতে পরিবারটির সদস্যরা জনপ্রতি বিনিয়োগ দেখিয়েছেন ৭৫ হাজার ডলার।

এস আলমের পরিবারকে স্থায়ী বসবাসের অনুমতির নথিতে স্বাক্ষর করেন মো. খায়রুল আলম শেখ। তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি পাওয়া যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ পাচারের পথ সহজ করা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জবাবদিহি এড়াতে এ কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ এ জন্য পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্রসহ বিভিন্ন দপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন হয়। এরপরও কীভাবে একই দিনে দু’টি কাজ সম্পন্ন হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আইনজ্ঞরা।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে যদি কেউ বিদেশি বিনিয়োগ করে তবে তাকে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনিয়োগের পরিমাণ হিসেবে কমপক্ষে ৭৫ হাজার হাজার মার্কিন ডলার হতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ভারী শিল্পে বিনিয়োগ থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিনিয়োগের ছাড়পত্র দেয় এমন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সনদ প্রয়োজন হয়।

পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্রের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের অনেকেই বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে তাদের এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, স্থাবর সম্পত্তির বিক্রির সুবিধার্থে অনেকেই দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। অনেকে স্থায়ী বসবাসের অনুমতিও গ্রহণ করে থাকেন।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব আলীমুন রাজীব বলেন, আইন অনুযায়ী বিনিয়োগকারী হিসেবে স্থায়ী আবাসিক সুবিধা দেওয়া হয়। কোনো বিদেশি নাগরিক নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ বাংলাদেশে করলে তাকে স্থায়ী আবাসিক সুবিধা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কেউ নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে তিনিও বিনিয়োগকারী হিসেবে এ সুবিধা পেতে পারেন। ওই সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না।

অনুমোদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, আবেদনকারী স্থায়ী আবাসিক সুবিধার জন্য সনদ প্রদানে সরকারকে সন্তুষ্ট করেছেন। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) অধ্যাদেশ ১৪৯-এর অনুচ্ছেদ ৪এ-তে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এবং ১৯৭৮ সালের বাংলাদেশে নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) অধ্যাদেশের ৪বি অনুযায়ী, আবেদনকারীকে স্থায়ী আবাসিক অধিকার দেওয়া হলো। তিনি স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবেন। বাংলাদেশের বাসিন্দাদের মতো সব অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতার অধিকারী হবেন। দেশের নাগরিকের মতোই দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে। তবে সরকার কর্তৃক অর্পিত বা পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তি দাবি করতে পারবে না।

বাংলাদেশে শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকৃত অর্থ আবেদনকারী স্বদেশে অথবা বাংলাদেশের বাইরে ফেরত বা প্রেরণ করতে পারবেন না। অন্যথায় স্থায়ী আবাসিক সুবিধা বাতিল হবে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এস আলম পরিবারের মালিকানায় ৫৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা ছয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। আর ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তার ছেলে আহসানুল আলম। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন: ভারতীয় ভিসা সেন্টার বন্ধে বিপাকে ইউরোপগামী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী-শ্রমিকরা

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এস আলম ও তার পরিবার এমন দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন যে দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদিত নয়। তিনি পরিবারসহ বাংলাদেশে স্থায়ী আবাসিক সুবিধা নিয়েছেন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা এড়াতে এস আলমের পরিবার এ পন্থা অবলম্বন করেছে। দুই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ পাচার করেন অনেকে। যেসব দেশ ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামে পরিচিত সেসব দেশকে বিনিয়োগের জন্য বেছে নিয়ে নাগরিকত্ব নেন।

এস আলম পরিবারের সাইপ্রাস ও সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব রয়েছে। ২০০৭ সালে সাইপ্রাস গোল্ডেন পাসপোর্ট চালু করলে সুযোগ নিয়ে ২০০৯ সালে এস আলম ও ফারজানা পারভীন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে ক্যানালি লজিস্টিকস নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর পরিশোধিত মূলধন ২ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। এস আলম ও তার স্ত্রীর এতে শেয়ার রয়েছে ৭০ এবং ৩০ শতাংশ।


সর্বশেষ সংবাদ