পাকিস্তান থেকে ৩ যুগ পর যেভাবে দেশে ফিরলেন জাহানারা

জাহানারা বেগম
জাহানারা বেগম  © সংগৃহীত

১৯৮৭ সালের ঘটনা। সতিনের সংসারে লেগেই থাকতো ঝগড়া-বিবাদ। তাই কাজের সন্ধানে গিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন খুলনা নগরীর শেখপাড়ার জাহানারা বেগম। সঙ্গে ছিল সাত বছরের মেয়ে মায়া। দুবাইয়ের কথা বলে চক্রটি তাকে প্রথমে ভারত, পরে নিয়ে যায় পাকিস্তানের করাচিতে। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর রোববার (২ জুন) পরিবারের কাছে ফিরেছেন তিনি। তাকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত পরিবারের সদস্যরা।

হারানো স্বজন ফিরে পেয়ে আনন্দের অশ্রু সবার চোখে। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বজনরা তাকে দেখতে আসছেন। ৩৭ বছর পাকিস্তানে থাকায় বাংলা মুখে আটকে যাচ্ছে জাহানারা বেগমের। উর্দুতেই সবার সঙ্গে কথা বলছেন।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার টেংরাখালী গ্রামে ছিল জাহানারা বেগমদের বাড়ি। বাবা আব্দুল ওহাব ও মা মনোয়ারা বেগমের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে জাহানারা বেগম দ্বিতীয়। পরিবারের সবাই থাকতেন খুলনার শেখপাড়া প্রধান সড়কে। আশির দশকে রূপসা নদীর ওপারের আব্দুর রশিদের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দুবছর পর জন্ম হয় মায়া নামে কন্যা সন্তানের। কিছুদিন যেতে না যেতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন তার স্বামী। এ নিয়ে পরিবারে ঝগড়া লেগেই থাকত। সতীনের সংসারের কলহ থেকে বাঁচতে কাজের সন্ধান শুরু করেন তিনি। তবে কপাল দোষে পড়েন মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে, তবে তিনি একবারের জন্যও তা বুঝতে পারেননি। চক্রের সদস্যদের বিশ্বাস করে ১৯৮৭ সালে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন খুলনা নগরীর শেখপাড়া প্রধান সড়কের বাসিন্দা জাহানারা বেগম। সঙ্গে ছিল ৭ বছরের মেয়ে মায়া। দুবাইয়ের কথা বলে চক্রটি তাদের প্রথমে ভারত, পরে নিয়ে যায় পাকিস্তান। 

তার কিছুদিন পরে চক্রের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আশ্রয় হয় করাচি থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। সেখানেই কেটে গেছে ৩৭ বছর। এই দীর্ঘ সময় দেশে ফিরতে নানা চেষ্টা করেও পারেননি। গতবছর জাহানারা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ‘দেশে ফেরা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যের সঙ্গে। সংগঠনটির প্রচেষ্টায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে জাহানারার বাঁধা ছিল পাসপোর্ট, ভিসা, পরিচয়পত্র। সব বাঁধা পেরিয়ে দীর্ঘ ৬ মাসের প্রচেষ্টার পর শনিবার রাতে দেশে পৌঁছান তিনি। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর রোববার সকালে শেখপাড়ার বাড়িতে পা রাখেন তিনি। 

জাহানারা বেগম বলেন, বড় বাজার এলাকার রুস্তম নামে এক আত্মীয় তাকে দুবাই যাওয়ার প্রস্তাব দেন। রুস্তমের দুই স্ত্রী, মেয়েসহ জাহানারা মোট চারজন রওনা হন দুবাইয়ের উদ্দেশে। টানা ১০ দিন বাস, ট্রেন ও নৌকা ভ্রমণ শেষে পাকিস্তানের ওই গ্রামে পৌঁছান জাহানারা। ততদিনে তারা পাচারের বিষয়টি বুঝতে পারেন। এরপরের অনেক ঘটনাই তার মনে নেই। 

জাহানারা বেগমের ছোট ভাই শেখপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মো. মহসীন শেখ জানান, মেঝ বোনকে বাবা সারা দেশে খুঁজেছেন। ভারতে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় কলকাতা, দিল্লি, আজমির শরীফও খুঁজতে গিয়েছেন। কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। বোনকে না দেখে তিন বছর আগে বাবা মারা গেছেন। জাহানারা বেগমের স্বামী ১৯৯০ সালে মারা যান।

জাহানারা বেগম জানান, তিনি দেশে ফেরার জন্য এলাকার লোকদের বলতেন। চিঠি লেখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ফেরার কোনো উপায় পাননি। ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। মেয়ে মায়াকেও বিয়ে দেন সেখানে। এভাবেই দিন কাটছিল তার। 

পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জাহানারা বেগম বেড়াতে যান করাচির পাশের একটি গ্রামে। সেখানে এক বাঙালি পরিবার দেখে জানান, তার বাড়িও বাংলাদেশের খুলনায়। বাঙালি ওই পরিবারটি তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দেশে ফেরা’ পাকিস্তানি সংগঠক অলি উল্লাহ মারুফকে জাহানারা বেগমের কথা বলেন। অলি উল্লাহ মারুফ করাচির ওই গ্রামে গিয়ে জাহানারা বেগমের ছবি ও কিছু ভিডিও বাংলাদেশের সংগঠকদের কাছে পাঠান। তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে জাহানারা বেগমের ছবি ও ভিডিও আপলোড করেন। বাগেরহাটের কচুয়ার ওই গ্রামে, পরে খুলনায় যোগাযোগ করেন তারা। এরপর জাহানারা বেগমের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেন পরিবারের সদস্যরা। তিনি জীবিত রয়েছেন নিশ্চিত হওয়ার পর দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

জাহানারা বেগমের ভাইয়ের ছেলে মিশু শেখ জানান, যেহেতু ফুফু ৩৭ বছর আগে অবৈধভাবে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, সেহেতু বাংলাদেশি হিসেবে তাকে দেশে আনা সম্ভব ছিল না। এজন্য পাকিস্তানে ‘দেশে ফেরা’ সংগঠনের ওলি উল্লাহ মারুফের সহযোগিতায় তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট করানো হয়। কিন্তু ভিসা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। ‘দেশে ফেরা’ সংগঠনের পরামর্শে থানা-পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পর ৯০ দিনের ভিসা দেয় সরকার। ভিসা পাওয়ার পরদিনই আমরা টিকিট কাটি। শনিবার রাতে ফুফু ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছান।

জাহানারা বেগম বলেন, অনেক কষ্টের পরে দেশে এসে ভাই-বোনদের দেখে খুব ভালো লাগছে। মেয়ে মায়ার জন্য আবার তাকে পাকিস্তানে ফিরতে হবে। আগামী ১৬ আগস্ট তার ফিরতি ফ্লাইট। 

‘দেশে ফেরা’ সংগঠনের অ্যাডমিন তানভীর হাসান জানান, ভারত-পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে তাদের সংগঠকেরা রয়েছেন। পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমেই হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে কাজ করেন তারা। এ পর্যন্ত ১২৭ জনকে তারা পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence