চোখ দিয়ে ছেলেকে আর দেখা হলো না
- শেখ আব্দুল্লাহ্ ইয়াসিন, চবি প্রদায়ক
- প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৪ AM , আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২৩, ০৯:২৪ AM
দুই চোখে ভালো দেখতে পেতেন না আনোয়ারা বেগম। মেজ ছেলে দু’বছর আগে প্রথমে বাম চোখ পরে টাকা জমিয়ে ডান চোখের অপারেশন করায় মায়ের। কিন্তু সে চোখ দিয়ে বেশিদিন ছেলেকে দেখার সুযোগ হইনি মায়ের। নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় মেজ ছেলে রুবেল। বলছিলাম চট্টগ্রামের হাটহাজারী ঠিকাদার আব্দুল হালিম রুবেল হত্যাকাণ্ডের কথা।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করে মঙ্গলবার (১ আগস্ট) চট্টগ্রাম নতুন পাড়া বিআরটিসি সংলগ্ন মোড়ে রুবেলের পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দারা মানববন্ধন করেন। সে সময় তারা দোষীদের জামিন দেওয়ার বিষয়ে নিন্দা জানান। তাদের দাবি দোষীরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জামিনে বের হয়ে গেছেন।
রুবেলেরা ৫ বোন, ৩ ভাই। তিনি সবার মেজ। রুবেলের পিঠাপিঠি বোন শাহানাজ বেগম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন,গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে তার ভাই রুবেল কাজ থেকে ঘরে ফিরেন। ফ্রেশ হওয়ার সময় তার ভাইয়ের কাছে ফোন করেন অভিযুক্ত আসামি দিদার। তাকে মিটিং আছে বলে ডাকেন। না খেয়ে ভাই রুবেল রাত ১০টায় চলে যান দিদার সাথে দেখা করতে। দেখা করে তারা একসাথে রঙ চা'ও খান। চা খাওয়ায় শেষে রুবেলের মাথা অস্বাভাবিক লাগলে সে দিদারকে জানায়। দিদার ঠিক হয়ে যাবে বলে তাকে মিটিং এর নাম করে বিআরটিসির বিপরীত পাশে অন্ধকার একটি জায়গার দিকে নিয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পর পেছন থেকে আঘাত করেন অভিযুক্ত আসামি রোকনসহ বাকি অভিযুক্তরা। এতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করা হয় রুবেলকে। রুবেল ঘটনা বুঝতে পেরে দৌড়ে রাস্তার দিকে চলে আসে। সেখানেও তাকে কুপিয়ে মর্মান্তিকভাবে আহত করা হয়।
বোন শাহানাজ বেগমের দাবি সে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজেও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, তাকে জখম করে আসামিরা চলে গেলে সে অন্য এক সিএনজি ড্রাইভারের সহযোগিতা নিয়ে চমেকে আসেন। প্রায় ২৪ ঘন্টা জীবন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে মারা যায় তার ভাই রুবেল।
রুবেলের দুলাভাই ওয়াসিম, পেশায় বাস ডাইভার তিনি বলেন, আমার ভাইটাকে ১৪টি কোপ দেওয়া হয়েছে। তার দোষ কি ছিলো? সে লটারিতে টেন্ডার পেয়েছে। দিদার তার কাছে টেন্ডার চাইলে সে দিবে না বলে। এতটুকুই তার অপরাধ? কোন সুস্থ মানুষে তো এভাবে কাউকে হত্যা করতে পারে না। তারা অমানুষ। তারা কিভাবে জামিন ফেলো? আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
মা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলেটা রাতে ভাতও খেতে পারে নায়। তাকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলছে। বুধবার আমার চোখের অপারেশন হয়েছে, বৃহস্পতিবার ব্যান্ডেজ খুলছে। শুক্রবার আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলছে। আমাকে এই ঘটনা ঘরের কেউ তখন কোন কিছু জানায় নায়। আমি আমার ছেলেটাকে দেখতেও পারি নাই। তিনি আরও বলেন,আমার ছেলে তো চলে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাবো না। আমি বিচার চাই না। ওরা জামিনে বের হয়ে আমাদের হুমকি দিচ্ছে আমি আমার বাকি ছেলেদের জীবনের নিরাপত্তা চাই।
বড় বোন নূর নাহার বলেন, তারা মামলা তোলে নেওয়ার জন্য ভয় ভীতি দেখাচ্ছে। আমাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাই। তিনি দাবি করেন,তারা অর্থের বিনিময়ে জামিন পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন,দিদার তো আসামী। সে কিভাবে বের হয়ে রাজনীতি করে? তার বিভিন্ন পোস্টার রাস্তার মোড়ে এখনো আপনি দেখবেন।
রুবেলের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান আছে। ১২ বছর বয়সী বড় মেয়ে শানজু পড়ছে ক্লাস ফোরে। মানববন্ধনে দুই বছরের ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে সেও পিতা হত্যার বিচার দাবি করছে। পাশে তার নয় বছরের ছোট বোন তানজু আকতার ও সাত বছরের ছোট ভাই আরিফ উদ্দিনও প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে আছে।
শানজু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলে, আমার আব্বুকে যারা মারছে আমি তাদের আমি ফাঁসি চাই। আব্বুকে খুব মনে পড়ে। সে আরও বলে, বড় আব্বু আমাদের এখন দেখাশুনা করছে। তারা হুমকি দিয়েছে মামলা তোলে না নিলে তারা বড় আব্বুকেও মেরে ফেলবে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিআরটিসি বাসের টেন্ডার নিয়ে বিরোধের জেরে রুবেলকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে জখম করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ২৪ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মারা যান তিনি। এই ঘটনায় একই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিহতের মা বাদী হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় আট জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত ভার গ্রহণ করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। তবে ছায়া তদন্ত করে র্যাব। সে বছর ১৯ মার্চ রাতে ঢাকার ডেমরা থানার ডগাইর এলাকা থেকে প্রধান আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে রোকনকে র্যাব-৭ গ্রেফতার করে। সে সময় র্যাব ৭ এর কাছে হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ স্বীকার করে রোকন।
সে সময় র্যাব কর্মকর্তারা জানান, রুবেলকে হত্যায় গ্রেফতার রোকন সরাসরি অংশ নেয়। গ্রেফতারের পর রোকন র্যাবকে জানায়, নিহত রুবেল বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে গাড়ি লিজ নিয়ে ব্যবসা করতো। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রুবেলের সঙ্গে বিআরটিসি বাসের টেন্ডার নিয়ে অপর লিজ ব্যবসায়ী মো. দিদারের কথা কাটাকাটি হয়। এর জের ধরে ওইদিন রাত ১০টার দিকে দিদার ফোন করে রুবেলকে নতুনপাড়া মোবারক সড়কে আসতে বলে। দিদারের কথা মতো রুবেল সেখানে এলে ১১টার দিকে দিদার, মাসুদ, রোকন এবং তাদের আরও পাঁচজন সহযোগী মিলে রুবেলকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র (কুড়াল, চাপাতি এবং চাকু) দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়।