লাইলাতুল কদর, হাজার মাসের চেয়েও উত্তম যে রাত
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৩০ AM , আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৩৩ AM
আজ মঙ্গলবার ২৬তম রোজা। বিদায় নিতে যাচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। সারা দেশে আজ দিবাগত রাতে পালিত হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুল কদর বা শবেকদর। লাইলাতুল কদর বিশ্বের মুসলমানরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। লাইলাতুল কদরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই গৌরবময় রজনীতে মানুষের সারা বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।
লাইলাতুল কদর বা শবেকদর অর্থ হচ্ছে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ রাত। ইসলামী শরিয়ত মতে, এটি বছরের সবচেয়ে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ একটি রাত। এটি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়।
শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবে কদরে ইবাদত করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম: ৭৬০; বুখারি: ২০১৪)
অধিকাংশ আলেমের মতে, একুশতম রাত থেকে শুরু করে বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি এবং অধিক অগ্রাধিকারযোগ্য কথা। অবশ্য অন্যান্য রাতেও শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রমজান মাস ২৯ দিনের হোক কিংবা ৩০ দিনের, শেষ দশক শুরু হবে একুশতম রাত থেকে। এই হিসাবে উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী শবে কদর ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোর একটি হতে পারে। মহানবী (সা.) শবে কদরের খোঁজে ইতিকাফ করতেন। রমজানের শেষ দশকের যেকোনো রাতই শবে কদর হতে পারে। তবে বেজোড় রাতগুলো শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর খোঁজো। (বুখারি: ২০১৭)
শবে কদরের ফজিলত
সকল মাসের থেকে উত্তম মাস হচ্ছে মাহে রমজান। মাহে রমজান এর শবে কদরের রজনী হচ্ছে সবথেকে উত্তম এবং মহামান্বিত রজনীর সকল রাত থেকেও উত্তম একটি রাত। মহান আল্লাহ তাআলা শবে কদরের এই রাত্রে বান্দাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে থাকেন। তাই শবে কদরের রাতকে ভাগ্য পরিবর্তনের রাত বলা হয়ে থাকে।
শবে কদরের এ রাতে মহান আল্লাহ তাআলা মক্কার হেরা গুহায় হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম -এর মাধ্যমে আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ওপর পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন নাযিল করেন শবে কদরের এই রাতে। রমজান মাস সকল মাস থেকে উত্তম একটি মাস। কেননা এ মাসে সবথেকে বড় গ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়েছে। কোরআনের এই সুন্দর সংস্পর্শে লাইলাতুল কদরের এ রাত ভাগ্য অর্জন করেছে।
হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী লাইলাতুল কদর। উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহর প্রেমে সিক্ত, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত অর্জনের এক বিশেষ সুযোগের রাত লাইলাতুল কদর। ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে। আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামসহ সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ঊষা পর্যন্ত (সূরা কদর, আয়াত ১:৫)।
প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোর মধ্যে কোনো এক বিজোড় রাত হলো ভাগ্য নির্ধারণ বা লাইলাতুল কদরের রাত। ইরশাদ হচ্ছে- ‘শবে কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’। (সূরা কদর, আয়াত ৩)
রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। শবে কদর কোরআন নাজিলের রাত। এ রাতেই প্রথম মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম -এর মাধ্যমে মহান প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি কোরআন অবতীর্ণ হয়।
ইরশাদ হচ্ছে-‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারি ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)। শবে কদর এমন এক রাত, যে রাতে সৃষ্টজীবের পূর্ণ এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেক প্রাণির রিযিক, জীবিকাসহ সর্বপ্রকার কাজ-কর্ম নির্ধারণ করা হয় বলে এই রাতকে লাইলাতুল কদর বা পরিমাপ নির্ধারণী রাত বলা হয়।
মহান প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর কাছ থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)। এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর নূর বর্ষিত হয়। ফেরেশতাগণ এবং হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ রাতে জমিনে অবতরণ করেন। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না। (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত শরিফ)
মহিমান্বিত এ রজনীতে সমস্ত কুমন্ত্রনা, শয়তানি ওয়াসওয়াসা থেকে মুক্ত, অকেজো শয়তানের সমস্ত কাজ। হজরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘শয়তান এ রাতে কাউকে ক্ষতি বা রুগ্ন করতে পারে না, অথবা কোন বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে না এবং কোন যাদুকর তার যাদু কার্যকর করতে পারে না’।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন’। আবার কারো কারো মতে, ‘আল্লাহ এ বছরে যে সকল বিষয়ে নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন’। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহকারে ও সওয়াবের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে (রাত্রি জাগরত করবে), তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’। (বুখারি শরিফ)
শবে কদরের আমল
নফল নামাজ, তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল নামাজ। বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত ও দরূদ পড়া, তাওবা-ইস্তিগফার, দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, কবর জিয়ারত করা বিশেষ করে পিতা-মাতার জন্য ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। বান্দা তার প্রভুর কাছে চায়। আল্লাহ এতে ভীষণ খুশি হন।
আল্লাহ তার বান্দার প্রতি এতটাই অনগ্রহশীল যে, তিনি তাঁর কাছে না চাইলে অসস্তুষ্ট হন। ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন’ (তিরমিজি শরিফ)। মহান প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের পরওয়ারদিগার লজ্জাশীল ও দাতা; লজ্জাবোধ করেন যখন তাঁর বান্দা তাঁর কাছে দু’হাত ওঠায়, তখন তা খালি ফিরিয়ে দিতে’। (তিরমিজি, আবু দাউদ, বায়হাকি শরিফ)
শবে কদরের রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তে হবে। দুই রাকাত দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজগুলোতে কিরাত, রুকু-সেজদায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হবে। যাতে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা যায়।
নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকাতাই ছালাতিল লাইলাতিল কাদরি নফলে মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি– আল্লাহু আকবার।
অর্থ: আমি কাবামুখী হয়ে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য শবে কদরের দুই রাকআত নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম– আল্লাহু আকবর।
শবে কদরের নামাজ দুই রাকাত ও চার রাকাত করে আদায় করতে হয়। তারপর যত খুশি নফল নামাজ পড়তে পারবেন। এই নামাজের প্রতিটি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর একবার এবং সূরা ইখলাস তিনবার পড়তে হবে।
নামাজের পর নিম্নোক্ত দোয়াটি কমপক্ষে ১০০ বার পাঠ করা উত্তম।
‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, লা হাওলা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল্লাহ আলিয়্যিল আজিম।’
এই রাতে বেশি বেশি কোরআন পাঠ করতে হবে। কেননা এই রাত্রে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া মহান প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর প্রতি বেশি বেশি দরূদ শরিফ পড়তে হবে।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রাণাধিক মহান প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন; তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাওফা আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন’। (ইবনে মাজাহ শরিফ, সহিহ আলবানি)
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা মহিমান্বিত রাতটি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকিরসহ বিভিন্ন ইবাদতে কাটিয়ে থাকেন। দেশের বেশির ভাগ মসজিদে এই রাতে তারাবি নামাজে কোরআন খতম হয়। এরপর সদকা, জাকাতসহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার পর দোয়া করে থাকেন ইমাম ও খতিবরা। এই রাতে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন সবাই।